সোশ্যাল ফোবিয়া (Social anxiety disorder) কি? কী উপায়ে সোশিয়াল ফোবিয়া কাটিয়ে ওঠা যায়?

 অনেকেই এমন আছেন যারা অচেনা পরিবেশে আর পাঁচজনের সাথে সহজে মিশতে পারেন না। নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রাখেন। আমরা চলতি ভাষায় এদেরকে ই 'লাজুক' বা 'মুখ চোরা' বলি। স্বভাবগত ভাবে অনেকের মধ্যেই এমনটা দেখা যায়, কিছুটা অন্তরমুখী চরিত্র , অন্যদের সামনে সহজে স্বচ্ছন্দ হতে পারেন না।আমি মনে করি এটা দোষের কিছু নয়। সবাইকেই যে খুব সামাজিকতায় পটু ( সোশ্যাল এনিম্যাল ) হতে হবে এমন নয় মোটেও। কিন্তু ব্যাপার হলো , যদি অপরিচিত বা পরিচিত মানুষদের কে ফেস করতে আমরা অকারণে ভয় পেতে শুরু করি  , দৈনন্দিন কাজে যে সব সোশিয়াল এক্সচেঞ্জ প্রয়োজণ, সেগুলিকেও যদি এড়িয়ে চলতে শুরু করি এবং "সবাই আমাকেই লক্ষ্য করছে" ( অর্থাৎ আমাকে জাজ করছে ) এমন ভাবনায় যদি সর্বক্ষণ ভীত সন্ত্রস্ত থাকি , তবে এটাকে সিরিয়াসলি নেয়া উচিৎ, হয়তো আমরা সোশ্যাল এঞ্জাইটি ডিসঅর্ডার এর শিকার হচ্ছি।


সোশ্যাল ফোবিয়া বা সোশ্যাল এঞ্জাইটি ডিসঅর্ডার কি?


এটা এক ধরণের ক্রনিক মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা, যেখানে ব্যাক্তি যে কোনো সামাজিক আদান প্রদান থেকে ইচ্ছে করে দূরে সরে থাকে। বাইরের কাউকে ফেস করতে ভয় পেতে শুরু করে। অতি সাধারণ সোশ্যাল ইন্টারেকশনেও বিনা কারণে ভীত , সন্ত্রস্ত হতে শুরু করে। সমাজ বিমুখ হতে শুরু করে, অযথা উদ্বেগে ভোগে। পরিচিত বা অপরিচিত লোকেদের সাথে কথা বলতে অনীহা। নিজের সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন। "সবাই আমাকেই দেখছে" / " লোকে আমার সম্পর্কে কী ভাববে?" / " আমাকে নিয়ে  হাসাহাসি করবে " এই জাতীয় অমূলক ভাবনায় সর্বক্ষণ গুটিয়ে থাকে। লো সেল্ফ এস্টিম। দীর্ঘদিন একাকিত্ব ও সোশ্যাল ফোবিয়া নিয়ে চলা ব্যাক্তির  ডিপ্রেশন  এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে যায়। চলো জেনে নেই ঠিক কি কি কারণে সোশ্যাল এঞ্জাইটি ডিসঅর্ডার হতে পারে।

Social phobia

* Picture credit - Anxiety.org 

সোশ্যাল ফোবিয়া কেনো হয়? Reasons behind social phobia:


সোশ্যাল ফোবিয়া বা সামাজিক ভীতি অনেকের মধ্যেই থাকে। অনুমান করা হয় প্রায় দশ শতাংশ মানুষ এতে আক্রান্ত। আগেই বলেছি, এটি একটি মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা। সমস্যা গূঢ়তর আকার নিলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শুরুতে বা সামান্য ক্ষেত্রে, নিজের প্রচেষ্টায় অনেকেই এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। বিশেষজ্ঞরা এখনো নিশ্চিত নয় ঠিক কী কারণে অনেকে এই সমস্যার সম্মুখীন হয় , তবে যারা সোশিয়াল ফোবিয়া র শিকার তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে, যেগুলি তাদের সামাজিক ভীতি র পেছনে দায়ী।

1. পুর্ব অভিজ্ঞতা :

দেখা গেছে অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো অসুখকর ঘটনা অনেক সময় মনের উপর গভীর ছাপ রেখে যায়। ব্যাক্তি চেষ্টা করেও তা কাটিয়ে উঠতে পারে না। উপহাস , ঠাট্টাচ্ছলে বলা কোনো কথা , ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এগুলি মনের উপর এতটা ই প্রভাব ফেলে , অনুরূপ সামাজিক পরিবেশের প্রতি  এক ধরণের ভয় বা উদ্বেগ জন্ম নেয়। ফেস করতে ভয় হয়। আবারো উপহাসের পাত্র হওয়ার, আত্ম সম্মান হারানোর ভয়। রিজেকশনের ভয়। অনেকের ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত ভয়ই সোশিয়াল ফোবিয়া কে ট্রিগার করে।

2. অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্ব :

স্বভাবগত ভাবে অনেকেই কিছুটা ইনট্রভার্ট হন। নিজের মধ্যে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সহজে অন্যদের সাথে মিশতে পারেন না। একা থাকার এই মানসিকতা এদের সামাজিক জীবন থেকে  ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে দেয়।  যদি কখনো প্রয়োজনে সামাজিক মেলামেশা করতে হয় , তখন উদ্বেগে ভুগতে শুরু করেন। এই প্রবণতা  বাড়তে থাকলে, তা এক সময়ে সোশিয়াল ফোবিয়া র রূপ নেয়।

3. জেনেটিক বা বংশগত কারণ :

যদি পরিবারে ঘনিষ্ট আত্মীয়দের মধ্যে কারোর এই ধরণের এঞ্জাইটি ডিজঅর্ডার থাকে তাহলে এই সমস্যায়  আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়।

4. নিউরোলজিক্যাল ফ্যাক্টর :

জন্মগত ভাবে অনেকের মস্তিস্কের কিছু বিশেষ অংশের (hyperactive Amygdala)  অতি সক্রিয়তার কারণে সহজেই ভয়ের রেসপন্স তৈরী হয়। এই অতিরিক্ত ভয়ের অনুভূতি ই যেকোনো অপরিচিত পরিবেশ ফেস করতে উদ্বেগ বা এঞ্জাইটির মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

5. শারীরিক ত্রুটি বিচ্যুতি :

এটা দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এখনো আমাদের সমাজে  নিজের  ফিজিক্যাল এপিয়ারেন্স নিয়ে আমাদেরকে উপহাসের শিকার হতে হয়। এতে করে অনেক সময় ই আত্মবিশ্বাস কমতে শুরু করে , আমরা নিজেদের এপিয়ারেন্স নিয়ে অতি মাত্রায় সচেতন হয়ে যাই, এবং ভবিষ্যতে এক ই ঘটনার শিকার হওয়ার আশঙ্কা থেকে সামাজিক পরিবেশ এড়িয়ে চলতে শুরু করি। বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌছালে সবাই আমাকেই দেখছে / আমার চেহারা নিয়ে হাসাহাসি করছে এই জাতীয় ভাবনা মনকে আচ্ছন্ন করে তোলে। 

6. অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার :

হ্যা ঠিক ই শুনেছো, অতিরিক্ত মোবাইল নির্ভরতা আমাদের সোশিয়াল স্কিল কে প্রভাবিত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে ,যারা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে তাদের সামাজিক জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সময় কাটাতে কাটাতে "রিয়েল সিচুয়েশন হ্যান্ডেল" করার স্কিল কমতে থাকে। ফলে বাস্তব জীবনে যখনই সামাজিক মেলামেশার প্রয়োজণ পড়ে তখন আত্মবিশ্বাস হীনতা ও উদ্বেগের সৃস্টি হয়। 

7. স্ট্রং ইগো ও ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স  এর ঘাটতি :

এই দুটো কারণেই মানুষ ধীরে ধীরে সমাজ বিচ্যুত হয়ে পড়ে। ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স এর মতো সুপেরিওরিটি কমপ্লেক্সও মানুষ কে সমাজ বিমুখ করে তোলে। অন্যায্য প্রত্যাশা ( unrealistic expectation), নিজেকে 'অল পারফেক্ট' ভাবা , অন্যদের নিজের তুলনায় হেয় মনে করা ইত্যাদি ভাবনা থেকেই সমাজ বিমুখতা জন্ম নেয়। আসতে পারে ডিপ্রেশন , যা ভবিষ্যতে সোশ্যাল এঞ্জাইটি ডিসঅর্ডার এর দিকে ঠেলে দিতে পারে। 

সোশ্যাল ফোবিয়ার মূল লক্ষণ গুলি কি? What are the main symptoms of Social phobia? 


■ লজ্জা , জড়তা ও ভয়। মুখ ফেকাসে হয়ে যাওয়া।

■ অতিরিক্ত ঘাম হওয়া । গলা শুকিয়ে যাওয়া।

■ প্যালপিটেশন। ঘন ঘন নিশ্বাস নেয়া।

■ মাথা ঝিমঝিম করা। বমিভাব।

■ নার্ভাস ফীল করা। শরীর অবশ ও ভারী বোধ করা। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।

■ কথা বলতে অসুবিধা। হঠাৎ কথা হারিয়ে ফেলা।

■ বিনা কারণে রিজার্ভ থাকা।সামাজিক যোগযোগ এড়িয়ে চলা। লোকের সাথে 'আই কনটাক্ট' না করা। 

■ নিজের সম্পর্কে অতি মাত্রায় সচেতনতা। আত্মবিশ্বাস হীনতা। নিজের চলন-বলন সম্পর্কে সন্দিহান।

সামাজিক আদান প্রদানের ক্ষেত্রে এদের সবচেয়ে বেশী অসুবিধা হয়- 

● কোনো অচেনা লোকের সাথে কথা বলতে।

● কাউকে প্রয়োজনে কিছু জিজ্ঞেস করতে।

● ফোনে কথা বলতে।

● কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে , এমন জায়গায় যেখানে আগে থেকেই কিছু লোক উপস্থিত রয়েছে। যেমন কোনো শো রুম, রেস্তরাঁ , কনফারেন্স হল ইত্যাদি।

● স্কুল , কলেজ ,অফিস এর মতো পরিচিত জায়গাতে যেতেও অস্বস্তি বোধ হয় ।

● ইন্টারভিউ ফেস করতে ভয়। 

প্রচলিত চিকিৎসা (Conventional Treatment) :


টানা ছয় মাসের বেশী সময় যদি এই সোশিয়াল এঞ্জাইটি কারোর থাকে তাহলে বুঝতে হবে উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এটা যেহেতু   একটা মানসিক সমস্যা তাই সাইকোথেরাপী খুব কার্যকরী ভুমিকা নিতে পারে। বিশেষত Cognitive behavioural therapy এছাড়াও চিকিৎসক প্রয়োজন অনুসারে anti-depressent জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন। 

সেল্ফ ম্যানেজমেন্ট : 

অবহেলা না করে শুরুতেই সচেতন হলে ভবিষ্যতে জটিলতা এড়ানো সম্ভব। যদি বুঝতে পারো তোমার মধ্যও সোশ্যাল ফোবিয়া র লক্ষণ রয়েছে , আজই সচেতন হও। রইলো তোমাদের জন্য কার্যকরী কিছু টিপস।

🔷️ এক্সেরসাইজ কর নিয়মিত। এতে  দৈহিক স্ফূর্তির পাশাপাশি মনও শান্ত হয় । গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত শরীরচর্চায় আত্মবিশ্বাস বাড়ে।

🔷️ অপরিচিত মানুষের সাথে বিনা প্রয়োজনে কথা বলা অভ্যাস কর। শুরু করতে পারো বাচ্চাদের সাথে কথা বলে। পড়ায় বয়স্ক মানুষদের সাথেও সময় কাটাতে পারো, ওদের সাথে বন্ধুত্ব কর , গল্প কর, জীবণ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা বাড়বে। 

🔷️ কম্ফর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ভয়  কে ফেস কর। নিজেকে অচেনা পরিবেশে একটু একটু করে এক্সপোজ করো। 

🔷️ একা একা রেস্তরাঁয় বা মুভি দেখতে যেতে পারো। সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দাও। লোকের সাথে আই কন্টাক্ট ও কুশল বিনিময় কর। মনে রেখো স্বচ্ছ , সুন্দর হাসি যেকোনো পরিবেশ কে ই কম্ফর্টেবল করে।

🔷️ নিজের   ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স  কিভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে মনোযোগ দাও।

🔷️ নিজেকে নিয়ে এতো সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই। কেউ 'অল পারফেক্ট' নয়। নিজের ভুল ভ্রান্তি তে নিজেই হেসে ফেলো। দেখবে অন্যের করা  কমেন্ট তখন আর তেমন প্রভাব ফেলবে না।

🔷️ মনকে শান্ত ও একাগ্র করতে নিয়মিত মেডিটেশন   ও  ডিপ ব্রীদিং   প্র্যাক্টিস কর। মেডিটেশন শুধু মনকেই স্থির করে না, পজিটিভ থাকতেও সাহায্য করে।

🔷️ যেখানে তোমাকে কেউ চেনে না সেরকম কোনো ইনস্টিটিউট, ক্লাব , স্পোর্টস এসোসিয়েশনে যুক্ত হতে পারো। বন্ধুত্বপূর্ণ ও খোলা মন নিয়ে সবার সাথে মেশো । ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজের পরিচিতি গড়ে তোলো।





🌻 সোশ্যাল এঞ্জাইটি ডিসঅর্ডার এবং এর ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে নীচে দেয়া ই-মেল বা হোয়াটস এপ  নান্বারে যোগাযোগ করতে পারো 


Email - anjanroynlp@gmail.com 


Whats app -

 7629968985






মন্তব্যসমূহ

  1. বর্তমান সময়ে ব্যস্ত জীবনের একটা জ্বলন্ত সমস্যা এটা। খুব সুন্দর করে প্রতিবেদনটা তুলে ধরেছেন।খুব ভালো লাগলো পড়ে। অনেককিছু জানতে পারলাম। 👌👌

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ডিপ্রেশন কে হালকা ভাবে নিয়ো না

চাকরি হারানোর ভয় কি আপনাকে রাত দিন তাড়া করে বেড়াচ্ছে?

2023 এ সুস্থ থাকতে ও অতিমারী থেকে বাঁচতে আজই শিখে নাও ডিপ ব্রীদিং