মেডিটেশন কী? মেডিটেশন কিভাবে করে? মেডিটেশন এর বিভিন্ন পদ্ধতি ও উপকারিতা
কোভিড পরবর্তী সময়ে, আমাদের মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে । স্বাভাবিক ভাবেই যোগা , মেডিটেশন , প্রানায়াম ইত্যাদির সম্পর্কে আগ্রহ বেড়েছে। অনেকেই নিয়মিত meditation করছো বা করার চেষ্টা করছো। আজ এখানে আলোচনা করবো , Meditation বা ধ্যান কি? ধ্যান করার সঠিক নিয়ম কি ? ধ্যানের বিভিন্ন পদ্ধতি এবং ধ্যান করার উপকারিতা ( benefits of meditation) সম্পর্কে।
মেডিটেশন কি ?
প্রাথমিক ভাবে ধ্যান বা মেডিটেশন হলো এমন এক বিশেষ প্রক্রিয়া যেখানে সচেতন ভাবে ব্যক্তি নিজের সমস্ত ফোকাস কে কোনো এক বিশেষ জায়গায় ( যেমন নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসে , বা নিজের দেহে , কোনো বিশেষ মন্ত্র , বা নির্দিষ্ট কোনো শব্দ তরঙ্গে, বা অন্য কিছুতে ) নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থির ও কেন্দ্রীভূত করতে পারে । এর আসল উদ্দেশ্য হলো মুলত আমাদের স্বভাব-চঞ্চল মন কে নিয়ন্ত্রণ করা। মজার ব্যাপার হলো মন কে শান্ত ও নিয়ন্ত্রিত করতে এখানে আমাদের ' *মেন্টাল ফেকাল্টি ' গুলি কে ব্যবহার করা হয়। নিয়মিত ও পর্যাপ্ত অভ্যাসে মনোযোগ বাড়ে , মনের চঞ্চলতা দূর হয় , প্যারা সিমপ্যাথিক নার্ভাস সিস্টেম এক্টিভেট হওয়া য় স্ট্রেস লেভেল কমে এবং ব্যক্তি দেহ-মনে রিলাক্স ও পজিটিভ ফীল করে । ব্যবহারিক জীবনে ধ্যানের আসল উদ্দেশ্য শরীর ও মন কে সিনক্রোনাইজড করা এবং সচেতন ভাবে কোনো কিছুতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফোকাস করা। দীর্ঘ ও নিয়মিত অভ্যাসে ধীরে ধীরে মনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। তখন আমরা সচেতন ভাবে আমাদের ' ফোকাস করার ক্ষমতা ' কে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারি। নিয়মিত অভ্যাসে মনোসংযোগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
* Imagination, Will, Perception, Intuition, Reason and Memory .
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতে ধ্যানের অনুশীলন লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন হিন্দু ধর্মেই সম্ভবত সর্বপ্রথম যোগ এর অনুষঙ্গ হিসেবে meditation বা ধ্যান এর ধারণা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে অন্যান্য ধর্ম ও সংস্কৃতিতে ধ্যানের প্রচলন হয় ও বিভিন্ন টেকনিক এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানও সামগ্রিক সুস্থতার ( শারীরিক , মানসিক , বৌদ্ধিক ও আত্মিক ) লক্ষ্যে 'ধ্যান' এর অপরিহার্যতা কে এক বাক্যে স্বীকার করে।
ধ্যান করার সঠিক পদ্ধতি কি?
এমনিতে দিনের যেকোনো সময়েই ধ্যান করা যায় । কিন্তু যারা সবে প্র্যাকটিস শুরু করেছো বা করবে , অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে ধ্যান করার সঠিক সময় কি? তোমাদের বলি , ভোরবেলা ( 4.30 থেকে 6 টা ) বা মধ্যরাতের সময় টা ( 12 টার পর ) প্রেফার করবে। ভালো করে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে , আরামদায়ক পোষাক পড়ে নিয়ে প্রথমে অল্প কিছু টা সময় প্রাণায়াম করবে। যৌগিক ধারণা অনুযায়ী প্রাণায়াম মেডিটেশন এর জন্য শরীর ও মনকে প্রস্তুত করে। তারপরে ধ্যান শুরু করবে। ঘরের ভেতরে বা বাইরে কোনো একটা কম্ফর্টেবল জায়গা বেছে নাও। রোজ একই জায়গায় প্র্যাকটিস করবে। ধ্যান করার অনেক টেকনিক আছে। তার মধ্যে থেকে তোমার পছন্দের কোনো একটি কে বেছে নিয়ে শুরু কর। সবসময় সুখাশন বা পদ্মাশনে বসেই ধ্যান করতে হবে এমন নয়। চেয়ারে বসেও করা যায়, শুধু খেয়াল রাখবে মেরুদণ্ড যেন সোজা থাকে ( Spine should be erected and straight )। সাধারণত চোখ বন্ধ করেই ধ্যানে বসতে বলা হয়, এতে করে distraction কম হয় এবং কনসেন্ট্রেট করতে সুবিধা হয়। আর একটা কথা , কোনো কিছু পাওয়ার মানসিকতা নিয়ে ধ্যানে বসবে না। নিয়মিত অভ্যাস জরুরী। প্রথমে 10 মিনিট থেকে শুরু করো। টাইমার সেট করে বসবে। এবার আলোচনা করবো ধ্যান এর কয়েকটি জনপ্রিয় / প্রচলিত টেকনিক সম্পর্কে।
Yogic Meditation :
সাধারণত যোগচর্চার অঙ্গ হিসেবে এই ধরণের ধ্যান এর প্রচলন শুরু হয়েছিলো। মহর্ষি পতঞ্জলী র যোগ ভাবনার " অষ্টাঙ্গের " মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে এই বিশেষ ধরণের ধ্যান বা মেডিটেশন টেকনিক যা তৎকালীন যোগচর্চায় অনুষঙ্গ হিসেবে অভ্যাস করা হতো। এই ক্ষেত্রে মূলত কোনো একটি নির্দিষ্ট যোগাশনে বসে বা শুয়ে প্রথমে দেহ কে সম্পূর্ণ স্থিরীকৃত করা হয়। তারপর বাহ্যিক সমস্ত রকমের সেন্সেশন গুলিকে সচেতনভাবে বন্ধ করার জন্য মনকে ( ফোকাস ) internally ফোকাস করা হয়। দেহের অভ্যন্তরে কোনো কাল্পনিক বিন্দুতে, কোনো নির্দিষ্ট মন্ত্রে বা নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসে সচেতন ভাবে ফোকাস করা হয়। ফোকাস কে আরও গভীর করার জন্য ধ্যানের উপযোগী কিছু মুদ্রার ব্যবহার করা হয় এগুলিকে "ধ্যান মুদ্রা" বলে। ধ্যান যতো গভীর হবে, ধীরে ধীরে মনের উথাল পাতাল কমতে থাকে। এক সময় সম্পূর্ণ thoughtless state এ পৌছা সম্ভব। এখান থেকেই meditative experience এর পথে যাত্রা শুরু হয়।
Mindfulness meditation :
সাম্প্রতিক কালে এই ধরণের মেডিটেশন টেকনিক আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এই মেডিটেশনের মূল লক্ষ্য " Finding joy , inner peace and happiness." স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ও মনকে শান্ত করতে এই ধরণের ধ্যান খুব ই উপযোগী। এখানে শুধু সচেতন ভাবে নিজের উপস্থিতিকে ফীল করতে হয় এবং নিজের মনের ভাবনা গুলি ( thoughts and emotions ) ও চারপাশের বহ্যিক জগৎ ( external sensetion) কে শুধু নিরপেক্ষভাবে ( personally attached না হয়ে অর্থাৎ কোনো রকম interpretation ছাড়া ) অবজারভ করতে হয়।
Chakra meditation :
প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে এবং তন্ত্র শাস্ত্রে এই ধরণের ধ্যান এর প্রচলন ছিলো। এখানে মনে করা হয় মানব দেহে সাত টি চক্র বা এনার্জি ফিল্ড রয়েছে যেগুলি আমাদের জীবনকে (শারীরিক , মানসিক , বৌদ্ধিক ও আত্মিক) প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। শরীরে সাত টি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় এই চক্র গুলি অবস্থান করে। যেমন পিঠের একেবারে নীচের দিকে , যেখান থেকে মেরুদন্ড শুরু ( base of the spine) হয় , সেখানে থাকে Muladhara Chakra , এর একটু উপরে স্যাক্রাল রিজিয়নে রয়েছে Svadhisthana Chakra , আরেকটু উপরের দিকে নাভির পার্শ্ববর্তী অংশে Manipura Chakra , আরও উপরে বুকের ঠিক মাঝ বরাবর রয়েছে Anahata Chakra গলায় থাকে Vishuddhi Chakra , কপাল এর মাঝখানে ( পিনিয়ল গ্ল্যান্ড ) থাকে Ajna Chakra আর একেবারে ব্রম্হরন্ধ্রে র দুই ইঞ্চি উপরে রয়েছে Sahasrara Chakra এদের প্রত্যেকটির রয়েছে নির্দিষ্ট রং । এই ধরণের মেডিটেশনে প্রতিটি চক্রের অবস্থান ও কালারের উপর ফোকাস করা হয়।
Vipassana meditation :
আজ থেকে প্রায় 2500 বছর আগে ভারত বর্ষে এই বিশেষ মেডিটেশন টেকনিক এর প্রচলন হয়। জীবের যাবতীয় দুঃখ কষ্ট দূর করার উদ্দেশ্যে ভগবান বুদ্ধ এই ধরণের ধ্যান এর প্রবর্তন করেন। Vipassana শব্দের অর্থ হলো অন্তর্দৃষ্টি । একাগ্রতা , মনের শান্তি , জীবের শাশ্বত আনন্দময় সত্ত্বা কে উপলব্ধি করার জন্য এই ধরণের ধ্যান অত্যন্ত কার্যকরী। এখানে কোনো কিছুর সাথে attach না হয়েও , কী ভাবে নিজের অস্তিত্বকে experience করতে হয় , তা শেখানো হয়। আধুনিক 'মাইন্ডফুল মেডিটেশন' এর সাথে এর মিল রয়েছে।
Transcendal Meditation :
এই ধরণের মেডিটেশনে শান্ত হয়ে বসে, চোখ বন্ধ করে একটি নির্বাচিত মন্ত্রের উপর ফোকাস করতে হয়। অন্তত 20 মিনিট মনে মনে chant করতে বলা হয়। এতে শরীর ও মন শান্ত হয়। ব্যক্তি পজিটিভ ও কনফিডেন্ট ফীল করতে শুরু করে ।
Guided Meditation :
এটা এক ধরণের সেল্ফ হিপ্নোসিস, এখানে সচেতন ভাবে এমন কোনো সিচুয়েশন, দৃশ্য বা পরিবেশ কল্পনা করে নেয়া হয় যেটা রিলাক্সিং , দেহ - মনে প্রশান্তি এনে দেয়। এই ধ্যান নিয়মিত অভ্যাসে ধীরে ধীরে আমাদের চিন্তা ভাবনা সদর্থক হয়ে ওঠে।
Sound healing meditation :
এটাও এক ধরণের focussed awareness মেডিটেশন । এখানে মূলত বাহ্যিক sensory signal গুলিকে বন্ধ রেখে শুধু একটি নির্দিষ্ট শব্দ তরঙ্গের উপরে ফোকাস করা হয়। অভ্যাসে ধীরে ধীরে মন শান্ত হয় এবং ব্যক্তি ধ্যান এর গভীরে ( trance like state ) প্রবেশ করে।
**ধ্যানের উপকারিতা ( benefits of meditation )
● Self awareness বাড়ায় :
নিয়মিত মাইন্ডফুলনেস অভ্যাসে নিজের thought process ও emotions সম্পর্কে ধারণা জন্মে। নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে জানা যায়, self awareness আমাদেরকে সচেতন ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলি নিতে সাহায্য করে। কনফিডেন্স বাড়ে ।
● Stress manage করতে সাহায্য করে :
মেডিটেশন মনের সামগ্রিক সুস্থতার পক্ষে খুব ই কার্যকরী ভূমিকা রাখে। Clinical Psychology Review র এক স্টাডি তে দেখা গেছে , বিপদের সময় বা স্ট্রেসফুল সিচুয়েশনে শরীরে cortisol হরমোন তৈরী হয় , রক্তে যদি দীর্ঘদিন এই স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বেড়ে থাকে ( ক্রোনিক স্ট্রেস ) তাহলে এটা আমাদের মেটাবলিজম, ইম্যুনিটি, পরিপাক ক্রিয়া ও হৃদযন্ত্রের উপর কুপ্রভাব ফেলে। ধ্যান স্ট্রেস কে কম করে ও আবেগের ঝড় কে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
● ডিপ্রেসন কাটাতে সহায়ক :
নিয়মিত mindful মেডিটেশন অভ্যাসে ডিপ্রেসনের লক্ষণ গুলি প্রশমিত হয়। ডিপ্রেসনে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে করা এক সমিক্ষায়, 3 মাস ব্যাপী "যোগা ও মেডিটেশন রিট্রিট " শেষে তাদের মধ্যে ডিপ্রেসনের লক্ষণ গুলি র উন্নতি ও স্ট্রেস হ্যন্ডেল করার ক্ষমতার বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।
● Memory ও Concentration বাড়ায় :
যেকোনো রকমের ধ্যান ই মনের বিকার কে শান্ত করে কনসেনেট্রশন বাড়াতে সাহায্য করে। নিয়মিত অভ্যাসে attention span ও বৃদ্ধি পায়। যারা নিয়মিত ধ্যান করেন তাদের মস্তিস্কে gray matter বৃদ্ধি পায় ও hippocampus এর কার্যক্ষমতা বাড়ে। ফলে স্মৃতি শক্তি ও ক্রিয়েটিভিটি র উন্নতি হয়।
● Blood pressure কমাতে সাহায্য করে :
মেডিটেশন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে । নিয়মিত ধ্যান অভ্যাসে মেটাবলিজম ও gut health এর উন্নতি হওয়ায় , স্বাভাবিকভাবেই স্থূলত্ব নিয়ন্ত্রিত হয়। স্ট্রেস , স্থূলত্ব , অনিদ্রার মতো ফ্যাক্টর গুলিকে দূর করে উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে ।
● অনিদ্রা দূর করে :
মেডিটেশন দেহ - মন কে শান্ত করে অনিদ্রা দূর করতে সাহায্য করে। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় যে factor গুলি যেমন দুশ্চিন্তা , ভয় , যন্ত্রণা ( mental or physical pain ) , ডিপ্রেশন ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে ভালো ঘুমে সহায়তা করে। মাত্র 20 মিনিটের মেডিটেশন পুরো একঘন্টা ঘুমের সমান সুফল দেয়।
পরিশেষে শুধু এইটুকু ই বলবো, নিয়মিত ধ্যানের অভ্যাস শুধু মন কে শান্ত , একাগ্র ও দেহকে সুস্থ , সতেজ ই রাখে না , experiential level এ গোটা জীবনটা কেই পাল্টে দিতে পারে।
No Meditation, No Life
Know Meditation, know Life
** তথ্য সহায়তা - Forbs Health
দারুণ তথ্য সম্বলিত লেখা। খুব ভালো লাগলো পড়ে👌🌹👌
উত্তরমুছুন