ডিপ্রেশন কে হালকা ভাবে নিয়ো না
আজকাল অনেক কেই বলতে শোনা যায়, " আমি ডিপ্রেসড " বা "ও ডিপ্রেশনে র মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে " । আমরা অনেকেই সাধারণ 'মন খারাপ' বা 'মূড অফ' কে ই ডিপ্রেশন ভাবি। ব্যাপারটা কিন্তু এতো সহজ নয়। এটা একটা জটিল মানসিক ব্যাধি ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা যাতে করে এতে যে কেউ , যে কোনো বয়সেই আক্রান্ত হতে পারে। এটাকে একটা মানসিক বিপর্যয়ও বলা যেতে পারে , একে হালকা ভাবে নিলে ভবিষ্যতে আরও বড়ো বিপদ হতে পারে। সাম্প্রতিক ডিপ্রেশনে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ । শুধু ভারতেই এই মুহুর্তে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ কোটিরও বেশী ! শহুরে জীবনে অভ্যস্ত মানুষেরা এই রোগে আক্রান্ত হোন বেশী। এখানে আমরা জানার চেষ্টা করবো ডিপ্রেসন আসলে কি? এর লক্ষণ গুলি কি কি? কেনই বা হয় এই রোগ ? এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিভিন্ন উপায় গুলি কি?
এটা এমন একটা মানসিক ব্যাধি যাতে আমরা নিজের অজান্তেই আক্রান্ত হই । বিনা কারণেই মন খারাপের পালা শুরু হয় এবং তা চলতেই থাকে। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। কোনো কিছু করার উৎসাহ / উদ্দীপনা থাকে না। মনোযোগের অভাব। ভীষণ কান্না পায়। কখনো কখনো রাগের বিস্ফোরণ ঘটে। বিনা কারণে নিজেকে দোষী / অপরাধী মনে হয়। অন্যদের থেকে আলাদা থাকতে ভালো লাগে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন বা অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায় । দেহের ওজন অনিচ্ছাকৃত ভাবে কমতে বা বাড়তে পারে। বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌছলে আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দিতে পারে। উপযুক্ত সময়ে রোগ চিন্হিত করে চিকিত্সা শুরু না করলে বড়ো ধরনের বিপদ ঘটে যেতে পারে ।
" ডিপ্রেশন বা মানসিক বিষণ্ণতা হলো এখন পর্যন্ত আমার দেখা সবচাইতে অপ্রীতিকর বিষয়.....যেখানে আপনি কল্পনা করতেও সক্ষম হবেন না যে আপনি আবার কখনো প্রফুল্ল হবেন। আশার চুড়ান্ত অনুপস্থিতি। "
- জে কে রাওলিং ( লেখক , গবেষক , মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক আইনজীবি )
আমরা এখানে জেনে নিলাম ডিপ্রেসন কি এবং এর প্রধান লক্ষণ গুলি কেমন হয়। যে কোনো বয়সের লোকই যেকোনো সময়ে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে দেখা গেছে পুরুষের তুলনায় মহিলারা এই রোগের শিকার হোন বেশী। এবার দেখে নেওয়া যাক ঠিক কি কি কারণে ডিপ্রেসন হতে পারে।
যদিও ঠিক কি কারণে আমরা ডিপ্রেশনের শিকার হই তা এখনও সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা যায় নি , এর কারন অনুসন্ধান যথেষ্ট জটিল প্রক্রিয়া। তবে কিছু কিছু ফেক্টর রয়েছে যেগুলি আমাদেরকে ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দিতে পারে । দেখে নেয়া যাক
ডিপ্রেশনের কারণ গুলি কি কি? / ডিপ্রেশন কেন হয়?
■ শারীরিক ও মানসিক শোষণ। দীর্ঘ অবহেলা , অবজ্ঞা ও উপহাস।
■ দীর্ঘ ও জটিল রোগভোগ। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ।
■ কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।
■ বয়স্ক ব্যক্তিরা বেশী আক্রান্ত হন। একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা ।
■ জীবনে হঠাৎ কোনো বড়ো পরিবর্তন । সবসময় দুঃখের বা কষ্টকর বিষয় না ও হতে পারে । যেমন কেউ কেউ বিয়ের পর বা প্রথম মা হওয়ার সময়ে এই রোগে আক্রান্ত হয়।
■ প্রিয়জনের আকস্মিক মৃত্যু বা বিচ্ছেদ।
■ জেনেটিক ফেক্টর। পরিবারে কোনো নিকট আত্মীয়ের ডিপ্রেসন এর ইতিহাস।
■ দীর্ঘদিনের নেশাসক্ত ব্যক্তি খুব সহজেই ডিপ্রেসনের শিকার হতে পারেন।
■ এছাড়া ও রয়েছে কিছু শারীরবৃত্তিয় কারণ যেমন মস্তিস্কের বায়ো-ক্যমিকেল অসংলগ্নতা , মস্তিস্কের 'হিপো ক্যাম্পাস' এর ছোটো হয়ে যাওয়া , থাইরয়েডে র সমস্যা ইত্যাদি আমাদের ডিপ্রেসনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা ই বাড়িয়ে দেয়।
" বিষণ্ণতা কোনো নির্বাচিত পছন্দ বা চয়েস নয়। এটি একটি গূঢ়তর অসুস্থতা এবং অন্যসব অসুস্থতার মতো এটিও চিকিৎসাযোগ্য। "
রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা :
সবচেয়ে বড় কথা সঠিক সময়ে রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা এই রোগ সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলে। অনেকেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে ইতস্তত করেন, এটা মারাত্বক ভুল। এই লক্ষণ গুলি নিজের বা পরিচিত কারোর মধ্যে থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিৎ। চিকিৎসক প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এর জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু ওষুধ এবং পাশাপাশি সাইকোথেরাপী , কাউন্সিলিঙ ও CBT র সাহায্য নেওয়া হতে পারে। এছাড়াও রয়েছে অত্যন্ত কার্যকরী কিছু মেডিক্যাল প্রসিডিওর যেমন ECT ( Electro convulsive therapy) এবং TMS ( Transcranial magnetic stimulation) ইত্যাদি ।
জেনেটিক্যাল বা বংশগত কারণে কারো কারো ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি তবুও নিয়মিত শরীর চর্চা , সঠিক খাদ্যাভ্যাস , পরিমিত ঘুম , সৃজনশীলতা , পরিবার পরিজনদের সাথে সুসম্পর্ক , আধ্যাত্মিক জ্ঞান চর্চা , যোগা ও মেডিটেশন এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা ই কমিয়ে দেয়।
" ডিপ্রেশন হলো আপনার নিজস্ব তথ্য প্রক্রিয়াকরণ গত ত্রুটি, অনুভূতি র সমস্যা নয়। "
- ডাঃ স্টিভ ইলার্ডি ( ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট )
আমাদের মন ও মানসিক স্বাস্থের সাথে ডিপ্রেসনের গভীর যোগ রয়েছে , তাই মন ও তার প্রকৃতি সম্পর্কে যদি আমাদের সঠিক ধারনা থাকে, তাহলে আমরা সহজেই মনকে আরও শক্তিশালী করতে পারবো। ইতিবাচক চিন্তাধারা আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে ও জীবন কে সম্পূর্ণ পালটে দিতে পারে। আমার ভীষণ প্রিয় একটি ভিডিও এখানে শেয়ার করছি, আশা করি তোমাদের ভালো লাগবে ।।
ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা সম্পর্কে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত দশটি প্রশ্ন / FAQs About Depression :
● বিষণ্নতা কি?
বিষণ্ণতা হল এমন একটি মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি যাতে একজন ব্যক্তি একবার আক্রান্ত হলে তার করা সমস্ত ক্রিয়াকলাপে ক্রমাগত দুঃখ, হতাশা এবং আগ্রহ বা আনন্দ হারানোর অনুভূতি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
● বিষণ্নতার লক্ষণগুলো কী কী?
হতাশার লক্ষণগুলির মধ্যে থাকতে পারে ক্রমাগত দুঃখ বা শূন্যতার অনুভূতি, কার্যকলাপে আগ্রহ বা আনন্দ হ্রাস, ক্ষুধা বা ঘুমের ধরণে পরিবর্তন, ক্লান্তি বা শক্তির অভাব, মূল্যহীনতা বা অপরাধবোধ, মনোযোগ দিতে অসুবিধা, এবং আত্মহত্যা বা আত্ম-ক্ষতির চিন্তাভাবনা ।
● বিষণ্নতার কারণ কি?
বিষণ্নতা একটি জটিল ব্যাধি যার একাধিক কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে জেনেটিক কারণ, মস্তিষ্কের রসায়নের ভারসাম্যহীনতা, পরিবেশগত চাপ এবং জীবনের গূঢ়তর ঘটনাগুলি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
● বিষণ্নতা কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
বিষণ্নতা সাধারণত শারীরিক পরীক্ষা, একটি মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়ন এবং একজন ব্যক্তির চিকিৎসা ইতিহাস পর্যালোচনার সমন্বয়ের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়।
● বিষণ্নতার কি চিকিৎসা করা যেতে পারে?
হ্যাঁ, কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ, সাইকোথেরাপি এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন যেমন ব্যায়াম , পর্যাপ্ত ঘুম এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের মতো স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের সংমিশ্রণের মাধ্যমে বিষণ্নতার চিকিত্সা করা যেতে পারে।
● বিষণ্নতা থেকে পুনরুদ্ধার করতে বা বেরিয়ে আসতে কতো টা সময় লাগে?
পুনরুদ্ধারের সময় হতাশার তীব্রতা এবং চিকিত্সার কার্যকারিতার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু লোক কয়েক সপ্তাহের মধ্যে উন্নতি দেখতে পারে, অন্যরা কয়েক মাস বা তার বেশি সময় নিতে পারে।
● বিষণ্নতা প্রতিরোধ করা যাবে?
বিষণ্নতা প্রতিরোধ করার এখন পর্যন্ত জানা তথ্য অনুযায়ী কোন নিশ্চিত উপায় নেই, তবে একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা, স্ট্রেসকে সঠিক ভাবে পরিচালনা করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলির জন্য উপযুক্ত চিকিৎসকের সাহায্য নেয়া সবই বিষণ্নতার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
● একবার সেরে ওঠার পরেও কি ডিপ্রেশনের লক্ষ্যণ গুলি আবার ফিরে আসতে পারে?
হ্যাঁ, বিষণ্নতার পুনরাবৃত্তি হতে পারে, এবং কিছু লোক তাদের সারাজীবনে একাধিক পর্ব বা পর্যায় অনুভব করতে পারে।
● হতাশা বা ডিপ্রেশন কি মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ?
না, বিষণ্নতা দুর্বলতার লক্ষণ নয়। এটি একটি মেডিকেল কন্ডিশন যা ব্যক্তির শক্তি বা চরিত্রের দৃঢ়তা র উপর নির্ভর করে না।
● বিষণ্ণতা কি আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে?
হ্যাঁ, বিষণ্নতা আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। আপনি বা আপনার পরিচিত কারোর মধ্যে হতাশার লক্ষণ অনুভব করলে বা আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা মনে এলে, তাৎক্ষণিকভাবে সাহায্য চাওয়া প্রয়োজণ।
তথ্য সহায়তা :
চমৎকার লিখেছেন। একেবারে সময়োপযোগী লেখা। আরও লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম। শুভ কামনা রইলো।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আপনাকে 🙏
উত্তরমুছুন