বাচ্চাদের হাতে মোবাইল! : গোটা প্রজন্ম ভয়ংকর বিপদের সম্মুখীন
এখনকার দিনে বাচ্চাদের হাতে মোবাইল একটা অতি সাধারণ ব্যাপার। অনেক মা বাবা কেই বেশ গর্ব করে বলতে শোনা যায়, তাদের বাবুসোনা কী ভীষণ স্মার্ট! এই ছোট্ট বয়সেই মোবাইলের সব ট্যাকনিকেল ব্যাপার-স্যাপার আয়ত্ত করে ফেলেছে। তিন বছরের বাচ্চা বাবার মোবাইলের প্যাটার্ন লক ওপেন করে ফেলছে ! বাবার তো আনন্দ হবেই 'ট্যাক উইজার্ড' সন্তান পেয়ে। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি শিশুদের স্ক্রিন আসক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে!এদের শৈশব আদতে আমরাই নষ্ট করছি। নিজেদের স্বার্থে ওদের হাতে মোবাইলটা আমরাই তুলে দিয়েছি। সারাক্ষণ ওরা মোবাইল নিয়ে বুঁদ হয়ে বসে থাকছে। এখন আক্ষরিক অর্থেই এদের মোবাইল সর্বস্ব জীবন! কোনো এক্টিভিটী নেই, সামাজিকতার শিক্ষা নেই, খেলাধুলা নেই। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে গাঁট হয়ে বসে থাকছে। বাবা-মাও নিশ্চিন্ত , বাচ্চা নানা প্রশ্ন করে আর মা কে জ্বালাতন করছে না, খেলার জন্য বায়না করছে না, যা দিচ্ছেন বিনা বাক্য ব্যয়ে গিলে ফেলছে, বেশিরভাগ সময় ঘরেই থাকছে , বাইরে যেতে বায়না করছে না। এখন তো আবার নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি , বাবা মা দুজনেই ব্যাস্ত, বাচ্চা সামলাবে কে? এতো সময় কৈ!! নিজেদের সুবিধার কথা ভেবে আমরাই ওদের হাতে মোবাইল তুলে দিয়েছি একদিন। দুঃখের বিষয় অনেক বাবা-মায়েরই সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই যে বাচ্চাদের মোবাইল দেখলে কি হয়? আজকাল ইন্টারনেট সংযুক্তির ফলে মোবাইল হয়ে উঠেছে এক অত্যন্ত শক্তিশালী ডিভাইস। কী নেই এতে? লিটেরালী গোটা দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয়। এই বিপুল পরিমাণ তথ্য ( abundance of information ) কে হ্যন্ডেল করার মতো ম্যাচুয়রিটি অনেক বড়োদের ই থাকে না, আর ওরা তো বাচ্চা! অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত কনটেন্ট আমাদের অজান্তেই শিশুমন কে দুষিত করছে। বয়সের আগেই ওরা অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে exposed হচ্ছে। তৈরী হচ্ছে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা, এর হাত ধরে ধীরে ধীরে শারীরিক অসুবিধাও দেখা যাচ্ছে। এখানে খুঁজে দেখার চেষ্টা করবো, বাচ্চাদের মোবাইল আসক্তি কমানোর উপায় কী সেই সম্পর্কে।অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে শিশুদের মধ্যে যে সমস্যা গুলো বেশী দেখা যাচ্ছে সেগুলি হলো-
শিশুদের মোবাইল আসক্তির কুফল:
● চোখে জ্বালা , বা ড্রাই আই। দৃষ্টি শক্তির দুর্বলতা। শর্ট সাইটেডনেস।
● কানে কম শোনা। মাথা ব্যথা।
● বয়সের আগে হরমোনাল চেঞ্জ।
● ছাত্র জীবনে মোবাইল ফোনের অপকরিতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। শিশুদের অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তি মনের বিক্ষিপ্ততা বাড়ায়। 'এটেনশন স্প্যান' কম করে।মনোযোগের অভাব তৈরী করে। দুর্বল স্মৃতি শক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
● স্থূলত্ব বা obesity র কারণ হতে পারে।
● দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া।
● অপরিমিত ও অপর্যাপ্ত ঘুম।
● খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ( Eating disorder)
● অনিয়ন্ত্রিত রাগের প্রকাশ , মূড সুইঙ , এঞ্জাইটি ডিজঅর্ডার ও ডিপ্রেশনে র মতো মানসিক জটিলতাও আজকাল বাচ্চাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ।
● ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্টস এর অভাব। সোশিয়াল স্কিল ডেভেলপ করে না। আচরণ গত ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়।
● কোনো কোনো গবেষক মাথা ও গলার কয়েক ধরণের ক্যান্সারের কারণ হিসেবে দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহারে নিসৃত রেডিয়েশন কে ই দায়ী করে থাকেন।
* মোবাইল নিসৃত রেডিয়েশনের ঝুঁকি কমাতে, লো সার ভ্যালু ( low SAR value ) যুক্ত মোবাইল ব্যবহার করুন । খেয়াল রাখবেন, আপনার ব্যবহৃত মোবাইলের SAR ( Specific Absorption Rate) value যেন 1.6 w/ kg বা তার কম হয়। আপনার ব্যবহৃত হ্যান্ড সেটের SAR value চেক করতে ডায়াল করুন *#07#
● বাচ্চাদের মধ্যে ইদানিং হরমোনাল ইমব্যালেন্স, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা ই বেড়ে গেছে।
শিশুদের মোবাইল আসক্তি দূর করার উপায়:
বাচ্চাদের মোবাইল আসক্তি কমানোর উপায় সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হলো, আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন ঠিক কী ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে সহজেই শিশুর স্ক্রিন আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
1. আগে নিজেরা সচেতন হোন -
একটু ভালো করে লক্ষ্য করুন তো সারাদিনে আপনার ' স্ক্রিন টাইম ' ঠিক কতটা? আপনি নিজেই মোবাইল আসক্তির শিকার নন তো? আর একটা কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাচ্চারা যা দেখে তা ই শেখে। কখন আপনি মোবাইলে কাজ করছেন আর কখন এমনিতেই স্ক্রল করছেন সেটা কিন্তু বাচ্চারা বোঝে না। ওরা কি দেখছে? কাজের সময়টুকু বাদ দিলে , বাকী সময়টা বড়োদের চোখ সব সময় মোবাইল স্ক্রিনে থাকছে। আমাদের আরও সচেতনভাবে মোবাইল ব্যবহার করতে হবে। ওদের সামনে যতটা সম্ভব মোবাইল এড়িয়ে চলুন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ল্যাপটপে করুন। আর যদি মোবাইলেই করতে হয়, কাজের জন্য সময় নির্দিষ্ট করুন।
2. বাচ্চাদের শরীরচর্চায় মনোযোগী হোন-
নিয়মিত শরীরচর্চার কোনো বিকল্প নেই। শরীর সুস্থ থাকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে ও মনের পজিটিভিটি বজায় থাকে। নিজেরাও এক্সেরসাইজ করুন, ওদেরকেও উৎসাহিত করুন।
3. বসে থাকতে দেবেন না, এনগেজ রাখুন -
মনে রাখতে হবে, শিশুদের এনার্জি লেভেল অনেক বেশী থাকে। এই এনার্জি কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। ডিসিপ্লিন তৈরী করুন। মোবাইল কে বাদ দিতে বলছি না। মোবাইল দেখার সময় নির্দিষ্ট করুন। বিনোদনের জন্য কোনো অবস্থায় দৈনিক এক ঘন্টার বেশী সময় বরাদ্দ থাকবে না । পড়াশোনা ছাড়াও, নাচ , গান , আবৃত্তি , ছবি আঁকা ইত্যাদি নিয়মিত রূপে প্র্যাক্টিস করান। বয়স অনুযায়ী সংসারের ছোটো খাটো দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করুন। ওদের সাথে ছোটো ছোটো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করুন, ওদের মতামত গুরুত্ব সহকারে শুনুন। দেখবেন , নিজেদের গুরুত্ব বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে দায়িত্ব নিতে শিখবে, রেসপনসিবল হবে।
4. যোগাযোগ বাড়াতে কথা বলুন সরাসরি -
কেনো আপনি ওদের মোবাইল ব্যবহারে রাশ টানতে চাইছেন, সে বিষয়ে ওদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করুন। কমান্ড দেবেন না। ওদের বোঝার উপযোগী ভাষায় আপনার এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণগুলি বুঝিয়ে বলুন। ছাত্রজীবনে মোবাইল ফোনের অপকারিতা সম্পর্কে তাদের সচেতন করুন। কারণগুলি আগে এক্সপ্লেইন করুন , তারপরে নিয়ম ইমপ্লিমেন্ট করবেন।
5. শুধু এন্টারটেইমেন্ট নয়,ফোকাস থাকুক লার্নিঙ এ -
তথ্য প্রযুক্তির যুগে মোবাইল একটা অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম বিভিন্ন নতুন বিষয়কে জানার। ওদের জন্য বিভিন্ন ইন্টারেস্টিং টাস্ক তৈরী করুন। যেগুলি ওরা কমপ্লিট করবে মোবাইলের সাহায্য নিয়ে। এতে করে ওরা মোবাইলের বিনোদন ছাড়া অন্য কার্যকরী ভুমিকা সম্পর্কে অবগত হবে। আগে প্রজেক্ট কমপ্লিট করবে , তারপর মোবাইল দেখতে পারবে ( এন্টারটেইমেন্ট )।
6. মোবাইলফ্রি ডে -
নিজেদের মধ্যে কথা বলে সপ্তাহে এমন একটি দিন বের করুন যে দিন টী হবে সম্পূর্ণ মোবাইল ফ্রি ডে । বাড়ীর কেউ সেদিন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মোবাইল ব্যবহার করবেন না। আর একটা কথা মনে রাখবেন, গাড়িতে , বাসে , ট্রেনে ট্র্যাভেল করার সময় বাচ্চাদের হাতে মোবাইল দেবেন না। গতিশীল অবস্থায় সিগনাল কেচ করার জন্য রেডিয়েশনের মাত্রা বেশী থাকে ।
7. রেস্ট্রিক্টেড জোন -
বাড়িতে কিছু কিছু জায়গায় মোবাইল ইয়ুজ রেস্ট্রিক্ট করুন। যেমন - বেডরুমে, খাবার টেবিলে কেউ মোবাইল ব্যবহার করবে না, বাড়ীর বড়োরাও না। অনেকেই জানতে চান, খাওয়ার সময় মোবাইল দেখলে কি হয়? এখানে বলি, শুধু ছোটরাই নয় বাড়ীর বড়োদেরও খাওয়ার সময় মোবাইল দেখা থেকে বিরত থাকা উচিৎ। এতে মনোযোগ মবিলের দিকে থাকায় খাবারের সময় আমাদের শরীরে যে সকল শারীরবৃত্তিয় কাজ গুলি চলে সেগুলি বাধা প্রাপ্ত হয়। ফলে পাচক রস ঠিক ভাবে নিসৃত না হোয়ার ফলে হজমের সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া মোবাইল দেখে খাওয়ার সময় আমাদের মস্তিস্ক 'পেট ভরে যাওয়ার' সঙ্কেত পাঠাতে কিছুটা বিলম্ব করায় অতিরিক্ত খেয়ে ফেলার সুযোগ তৈরী হয়, যা পরবর্তীতে স্থূলত্ব বা অবেসিটি র কারণ হতে পারে। সুতরাং বাড়িতে এই নিয়ম গুলো বড়োরাও মেনে চলা উচিত।
8. মেডিটেশন ও মাইন্ডফুলনেস -
নিয়মিত মেডিটেশন অভ্যাস আমাদের অনুভূতি গুলোকে ধারালো করে। উপিলব্ধির গভীরতা বাড়ে, দৃষ্টির স্পষ্টতা আসে। কোনো কিছুর প্রতি আমাদের আসক্তি থাকলে, তার প্রকৃত কারণ কী? সে বিষয়ে সম্মক ধারণা জন্মে। আসক্তি যে আসলে বহ্যিক তাড়নামাত্র এবং এই আসক্তি ছাড়াও যে আমাদের একটি স্বাধীন সত্ত্বা রয়েছে তার উপলব্ধি হয়। বাচ্চাদেরকে নিয়মিত মেডিটেশন প্র্যাক্টিস করান। আসক্তি ধীরে ধীরে কমে যাবে। বাচ্চা যদি আসক্ত হয়ে গিয়ে থাকে তবে আসক্তি কাটাতে ওকে নিয়ে রোজ মাইন্ডফুলনেস এর মজার খেলা খেলুন।
ওকে আসন করে বসতে বলুন। মোবাইল ওর সামনে থাকবে। ওর দৃষ্টি থাকবে মোবাইলের দিকে। চাইলে ফোনটা টাচ করেও থাকতে পারে। ওকে বলা হবে, চাইলে ও দেখতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত সময় থেকে 15 মিনিট বাদ যাবে । কিন্তু যদি নিজেকে 15 মিনিট রেজিস্ট করতে পারে, তাহলে 15 মিনিট এক্সট্রা দেখতে দেয়া হবে। 15 মিনিট রেজিস্ট করতে পারলে এর পরের ধাপে সময় বাড়িয়ে 30 মিনিট করুন। এই খেলা নিয়মিত খেলুন। দেখবেন, ধীরে ধীরে যে কোনো ধরণের প্রলোভন কে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে যাবে।
🌸 মোবাইল আসক্তির কুফল ও আসক্তি কাটানোর উপায় সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ে দেখুন -
অসাধারণ প্রতিবেদন। বর্তমানে প্রতি ঘরে ঘরে এই সমস্যায় অভিভাবককুল জর্জরিত।👌
উত্তরমুছুন