সকালে তাড়াহুড়ো করে বাড়ী থেকে বেরুতে গিয়ে কিছুটা রাস্তা এসেই বুঝতে পারলে তুমি পার্স / রোদ চশমা / জলের বোতল / টিফিন বক্স /ঘড়ি / ছাতা / পেন - এর কোনো একটা কে ফেলে এসেছো, কী করবে এবার ? যাবে ফিরে আবার সেটা আনতে?? মনে হয় না। কোনো ভাবে ম্যানেজ করে নেবে। কিন্তু ফেলে আসা জিনিস টা যদি হয় তোমার মোবাইল !!! তখন?? উত্তরটা আমাদের সবারই জানা । আজকাল মোবাইল শুধু প্রয়োজনীয় কোনো বস্তু নয়, মোবাইল আমাদের, ছোটো-বড়ো সবার বেঁচে থাকার জীয়নকাঠি। একটু কাব্য করে বললে, প্রাণাধিক প্রিয় , নিত্য ছায়া সঙ্গী। মোবাইল বিনে জীবণ কল্পনাও করা যায় না। এই অতিমাত্রায় মোবাইল নির্ভরতা ডেকে আনছে ভয়ংকর বিপদ। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের ব্যাক্তিগত ও সামাজিক জীবন। শারীরিক সমস্যার কথা যদি বাদ দেই , আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যও কিন্তু আজ প্রশ্নের মুখে। নিজেদের অজান্তেই আমরা ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ছি সর্বনাশা এই মুঠো ফোনে। আজ এখানে বোঝার চেষ্টা করবো,
মোবাইল আসক্তির কারণ
অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের কুফল
মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় কী?
FAQ
মোবাইল আসক্তির কারণ
প্রযুক্তির জয়যাত্রায় অবশ্যই একটা উল্লেখযোগ্য মাইল ফলক এই আধুনিক মোবাইল প্রযুক্তি। কী নেই তাতে! আক্ষরিক অর্থেই হাতের মুঠোয় গোটা দুনিয়া । বিগত দেড় দশকের বেশী সময় ধরে এই যন্ত্র টি আমাদের জীবন কে সহজতর ও কম্ফর্টেবল করে চলেছে। এক কথায় বললে মানব সভ্যতার ক্রম বিকাশে স্মার্টফোন অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবীতে তাই মোবাইল এখন আমাদের নিত্য সঙ্গী। প্রয়োজণের ভিত্তিতে এর ব্যবহার শুরু হলেও , ধীরে ধীরে এর মোহময়ী নানা ফিচার্সে আমরা খুঁজে পেতে শুরু করি বাধনহারা মুক্তির স্বাদ। ' যা খুশী , যেমন খুশী ' করতে পারার আনন্দ। শ্লীল - অশ্লীল এর প্রাচীর টা কে ভেঙ্গে ফেলা যায় এক নিমেষে । Abundance of information! অদেখা , অচেনা কতো কিছু এক্সপেরিয়েন্স করা যায় । অন্যের এটেনশন পেতে নিজেকে ইচ্ছা অনুযায়ী প্রেজেন্ট করা যায় । আরও কতো কী!! মনের অপূর্ণ ইচ্ছা গুলি পুরণ করার তাগিদেই আমরা আরও বেশী করে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছি । মোবাইল আসক্তির কারণ কী? এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে গেলে মূলত তিনটি কারণ উল্লেখ করতে হয় -
1. স্বাধীনতা লাভের ইচ্ছা । প্রচলিত রীতি-নীতি , ধ্যান-ধারণা কে ভেঙ্গে ফেলে মুক্তির স্বাদ পাওয়া র ইচ্ছা।
2. নিজেকে গুরুত্বপুর্ণ ভাবা । নিজের অহং ( ইগো ) কে তৃপ্ত করার বাসনা। এই জন্যেই আমরা অন্যদের attention/ প্রশংসা পেতে মরিয়া হয়ে উঠি।
3. সহজাত কৌতূহল । অজানা কে জানার আকাঙ্ক্ষা ।
উপরের বলা সবগুলো বিষয় ই যেহেতু মোবাইলের মাধ্যমে আপাতভাবে পুরণ করা সম্ভব , তাই আমরা মোবাইল কে আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরি। কোথাও না কোথাও social isolation এবং একাকীত্ব - এই দুটি ফ্যাক্টর আমাদেরকে আরও বেশী করে মোবাইল নির্ভর করে তোলে। বিনা প্রয়োজনে, অতিরিক্ত মোবাইল ইউজ করার এই অভ্যাস ধীরে ধীরে আমাদের কে আসক্ত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইলের ব্যবহারে যেহেতু ' অবদমিত ইচ্ছা ' র পূর্তি হয়, তাই মস্তিস্কে ' feel good ' হরমোন dopamine রিলিজ করে । তৃপ্তিতে ভরে ওঠে মন। মস্তিস্ক এক বিশেষ ধরণের কিক্ পায়। মস্তিস্ক এতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে , যে বারবার এই ' কিক্ ' পাওয়ার জন্য craving তৈরী হয়। এখান থেকেই জন্ম নেয় আসক্তি।
অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তির কুফল কি কি?
অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত মোবাইলের ব্যবহার শুধু আমাদের ব্যাক্তিগত ও সামাজিক জীবনের মান নষ্ট করছে এমন নয় , আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থেরও প্রভূত ক্ষতি সাধন করছে। একনজরে দেখে নেয়া যাক মোবাইল আসক্তির কুফল গুলি কি কি ?
● দৃষ্টিশক্তি দুর্বল করে। অনিয়ন্ত্রিত মোবাইলের ব্যবহারে চোখে জ্বালা , ড্রাই আই এর মতো সমস্যা তৈরী করে। সমস্যা গভীর হলে 'শর্ট সাইটেডনেস' , এমনকি চোখে সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ার ও চলে আসতে পারে।
● কোনো কোনো গবেষকের মতে অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার গলা ও মস্তিস্কের ক্যান্সার এর কারণ হতে পারে।
● পুরুষদের মধ্যে কমে যেতে পারে সুস্থ , সতেজ শুক্রাণুর সংখ্যা। মেল ইনফারটিলিটি র অন্যতম কারণ । কোরিয়ার একদল গবেষকদের করা স্টাডি তে উঠে এসেছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য। যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।
● অস্থি সন্ধির নানা সমস্যা দেখা যাচ্ছে ইদানিং। ঘাড়ে - পিঠে - কোমরে যন্ত্রণা তো আছেই। রয়েছে আরও নানা ধরণের জয়েন্ট ইনফ্ল্যামেশন। এদের নাম থেকেই বোঝা যায় এদের উৎপত্তি। যেমন - tech neck , cell phone elbow , texting thumb ইত্যাদি।
● অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে কমে যাচ্ছে শারীরিক সক্ষমতা এবং পর্যাপ্ত ঘুম, ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্থূলত্ব।
● দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে মোবাইল ব্যবহারে আকারে ছোটো হয়ে যেতে পারে মস্তিস্কের গ্রে ম্যাটার অংশ। কমে যেতে পারে স্মৃতি শক্তি।
● মোবাইল আসক্তির সব চেয়ে বেশী কুপ্রভাব পরে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য এর উপর। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডিপ্রেসন , এনজাইটি, এটেনশন সীকিং ডিজঅর্ডার এর মতো মানসিক ব্যাধি।
● কমে যাচ্ছে মনসংযোগ করার ক্ষমতা। মনের বিক্ষিপ্ততা বাড়ছে। হ্রাস পাচ্ছে এটেনশন স্পেন।
● ধ্যর্য, সহনশীলতা , লিসেনিং স্কিল কমে যাওয়াতে সামাজিক জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আসছে নি:সঙ্গতা , একাকীত্ব ও হতাশা।
● হিংসা ও অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় / How to become free from mobile addiction?
🔷️ মোবাইল ব্যবহার কর সচেতন ভাবে। নিজেকে অবজারভ কর , ঠিক কী পরিস্থিতিতে তুমি কীভাবে মোবাইল ব্যবহার করছো। অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এড়াতে সেল্ফ ডিসিপ্লিন প্র্যাকটিস কর। প্রতিদিন সোশিয়াল মিডিয়া ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সময় ঠিক কর।
🔷️ কাজের / পড়াশোনার সময় মোবাইল দূরে সরিয়ে রাখো। সোশিয়াল মিডিয়া এপস গুলির নোটিফিকেশন মিউট করে রাখো। বিশেষ প্রয়োজনে কল বা টেক্সট করতে ফোন ব্যবহার করতে পার ।
🔷️ টার্গেট কর যাতে দৈনিক এক ঘন্টার বেশী সময় সার্ফিং এ বা সোশিয়াল মিডিয়ায় ব্যয় না হয়। 30 মিনিট করে দিনে দুবার করতে পারো।
🔷️ Fake জিনিসের পেছনে সময় নষ্ট না করে, রিয়েল কিছু বেছে নাও। রিয়েল কাজে চ্যালেঞ্জ বেশী হলেও , করতে পারলে আনন্দটাও দ্বিগুণ পাবে।
🔷️ বিভিন্ন উজ্জল রঙ মনকে প্রলুব্ধ করে। মোবাইল screan এর আলো কমিয়ে রাখো। সেটিং এ গিয়ে grey scale অন করে রাখতে পারো । আজকাল বিভিন্ন এপস আছে যেগুলি নির্দিষ্ট কোনো এপ কে ব্লক করে অথবা সময় নির্দিষ্ট করে রাখে। প্রয়োজনে সেগুলি ব্যবহার করতে পারো।
🔷️ শুরুতে কিছু দিন ইমেইল বা অন্য অফিসিয়াল কাজে ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ ইউজ কর। সপ্তাহে একদিন রাখো সম্পূর্ণ 'মোবাইল ফ্রি' দিন।
🔷️ খেলাধুলা কর। পছন্দের হবি বেছে নাও। মানবিক সম্পর্ক গুলির প্রতি যত্নশীল হও।
🔷️ আসক্তি এড়াতে নিয়মিত কিছুটা সময় মেডিটেশন ও মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস করতে পার।
FAQ :
1. দৈনিক কতো টা সময় মোবাইল ব্যবহার করলে তাকে আসক্তি বলা হয়?
■ দুই ঘন্টা বা তার বেশী সময়।
2. Nomophobia কী?
■ এটা এক ধরণের মানসিক ব্যাধি যেখানে ব্যক্তি সর্বদা তার মোবাইল হারিয়ে ফেলা বা চুরি যাবার ভয়ে থাকে।
3. অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে কোন কোন মানসিক ব্যাধি দেখা যায়?
■ Anxiety এবং Depression
4. রাতে মোবাইল কোথায় charge এ বসানো উচিৎ?
■ Bedroom থেকে দূরে কোথাও।
5. কোন apps গুলি মোবাইল আসক্তি কাটাতে সাহায্য করে?
■ Flipd , Offtime , Forest, AppDetox ইত্যাদি ।
পরিশেষে এটুকুই বলবো, এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে মোবাইল একটা অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। একে হাতিয়ার করে জীবণ যুদ্ধে এগিয়ে যাও, একে তোমার দুর্বলতা বানিয়ে ফেলো না। আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সচেতন ভাবে মোবাইল ব্যবহার মোবাইল আসক্তি কাটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিতে পারে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন