নিজের মনকে জানতে -- পর্ব তিন
আমার পরিচিত একজন জানতে চেয়েছেন, উনার নাকি মাঝে মাঝে মনে হয় আগেই উনি ভালো ছিলেন। ব্যক্তি হিসেবে উনার যে পরিবর্তন হয়েছে , সেটা সুখকর হয় নি। তাই উনি আবার আগের ব্যক্তিত্বে ফিরে যেতে চান। এটা কি সম্ভব?
ব্যক্তিত্ব বহমান নদীর মতো, এক জায়গায় স্থির থাকে না, ক্রম পরিবর্তনশীল। একটু একটু করে আমরা প্রত্যেক দিন পাল্টাই। এটাই স্বাভাবিক। ক্লাস সেভেনে পড়া আমি, কলেজ ফার্স্ট ইয়ারে পড়া আমি আর আজকের আমি এক ব্যক্তি নই। ভালো-খারাপ সব মিলে মিশেই পরিবর্তন হয়েছে। এটা চলতেই থাকে। পরিবেশের প্রভাব, জীবনের অভিজ্ঞতা, জীবনের লক্ষ্য ও ইচ্ছা শক্তি এই পরিবর্তন গুলি ঘটায়। এই পরিবর্তন কিন্তু বাহ্যিক। আলোচনা করলে আরও কিছুটা গভীরে যেতে হবে, জানিনা কতটা বুঝিয়ে বলতে পারবো। তবুও চেষ্টা করছি।জীবনে , আমাদেরকে নাটকের মতো বিভিন্ন রোলে অভিনয় করে যেতে হয়, রোল অনুযায়ী ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন হয়। ফারাক শুধু এইটুকুই এখানে এক সাথে অনেক রোল প্লে করতে হয়। যে চরিত্রে আপনার ফোকাস বেশী থাকবে সেই আদলেই ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠবে। কিন্তু মুস্কিল টা হচ্ছে এক ই চরিত্রে আপনি সারাজীবন ফোকাস ধরে রাখতে পারবেন না। উদাহরণ দেই , ধরুণ আপনি কারোর মেয়ে। বাবা মায়ের আদরের মেয়ে। আপনি যখন নিজেকে কারোর মেয়ে ভেবে চলবেন, তখন কিছুটা মুডি, অভিমানি, রিলাক্স , নো টেনশন টাইপের, লেজী এই ধরণের চারিত্রিক গুনগুলি ব্যক্তিত্বে রিফ্লেক্ট করবে বেশী । আবার সেই আপনি ই যখন বিয়ের পর কারোর মা হবেন, তখন দায়িত্ববোধ, মায়া মমতা, সময় জ্ঞান , কষ্ট সহিষ্ণুতা , স্যাক্রিফাইজ করার মানসিকতা ইত্যাদি আপনার ব্যক্তিত্বে প্রকট ভাবে প্রকাশ পাবে। আপনি যে তখন মা এর রোলে অভিনয় করছেন ! এগুলি সব ই আস্তরণ। যা সময়ের সাথে ব্যক্তিত্ব কে একটু একটু করে চেঞ্জ করে। এতো সব কিছুর মধ্যেও যা পাল্টায় না, তা হলো আমাদের ভেতরের মানুষ টা, আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সত্তা। ভেতরের 'আমি' । হতে পারেন আপনি কারোর মেয়ে, বোন, বন্ধু , প্রেমিকা , স্কুলের শিক্ষিকা, স্ত্রী , মা — কিন্তু এর একটাও তো আসলে আপনি নন। এই সব আরোপিত চরিত্র গুলি বাদ দিলে, যে অবশিষ্ট থাকে, যার সাথে আপনি রোজ হাজার বার কথা বলেন, সুখে দুঃখে ছোটো বেলা থেকে যে সর্বক্ষণ আপনার সাথে ছিলো, মৃত্যুর আগ মূহুর্ত অবদি থাকবে ছায়ার মতো। সেটাই আপনার নিজস্ব সত্তা । বাবা- মা এর মৃত্যুর পরে আপনি তো আর কারোর মেয়ে হয়ে থাকবেন না, তখন ও কিন্তু আপনি ( আপনার অন্তসত্তা) থাকবেন ! ঠিক তেমনি একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে বাবা মা এর চরিত্রে অভিনয় শেষ। কিন্তু তারপরেও উনারা তো থাকবেন। সব কিছু বাদ দিলেও যা অবশিষ্ট থাকে , সেটা ই আসল আপনি।
যিনি আপনার কাছে জানতে চেয়েছেন, উনাকে বলবেন, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন আমাদের প্রত্যেকের জীবনে অনিবার্য। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই পরিবর্তন হয় সুপার ফিসিয়াল লেভেলে। কিন্তু একে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। আপনি চাইলেও ছয় বছর বয়সে আপনি যেমন ছিলেন সেই রকম আচরণ করতে পারবেন না। যেটা সম্ভব সেটা হলো , এখনকার সময় অনুপাতে জীবনে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা এবং সচেতন ভাবে ওই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে একটু একটু করে নিজেকে তৈরী করা। ব্যক্তিত্বে যদি পরিবর্তন করতেই হয় সেটা হবে সদর্থক । একাগ্রতা , সততা, পরিশ্রম করার মানসিকতা , দয়া, ভালবাসা - এই অমূল্য গুণ গুলি যে কোনো মানুষের ব্যক্তিত্ব কে অনন্য সাধারণ করে তুলতে পারে।
ভালো থাকবেন সবাই। 🙏
মাইন্ডফুলনেস কি? কিভাবে মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস করবো?
একটু ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যায়, দিনের অধিকাংশ সময়ে আমাদের মন বর্তমান কাজ বা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে থাকে না। মনের স্বভাব এমনই। দিনের নব্বই শতাংশ সময় আমাদের মন হয় অতীতচারন করতে থাকে নয়তো ভবিষ্যতের কল্পনায় বিভোর থাকে। মনের এই স্বভাবের জন্য আমরা কোনো কাজে গভীর ভাবে মনোযোগ দিতে পারিনা, আর মনোযোগ দিলেও, তা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারিনা। অতীতের নানা কষ্টের স্মৃতি বা ভবিষ্যতের অজানা কিছু ঘটে যাওয়ার অমূলক আশঙ্কা আমাদের আত্মবিশ্বাস কে নষ্ট করে, এবং জীবণ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেয়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে, মাইন্ডফুলনেস বা সচেতন জীবনশৈলী অভ্যাস অত্যন্ত কার্যকরী।
যে বিশেষ প্রক্রিয়ার দ্বারা , আমরা সচেতন ভাবে আমাদের সমস্ত ফোকাস কে বর্তমান সময়ে বা ঘটনা প্রবাহে স্থির ও কেন্দ্রীভূত করতে সমর্থ হই, তাকেই ' মাইন্ডফুলনেস ' বলে। এই প্রক্রিয়ায় সচেতন ভাবে, যথেষ্ট উৎসাহ ও সংস্কার মুক্ত খোলা মন নিয়ে , একটুও জাজ্মেন্টাল না হয়ে , চারপাশে ঘটে চলা ঘটনা প্রবাহের সাক্ষী হয়ে থাকতে হয়। ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে একটুও এটাচড না হয়ে বা কোনোরকম 'বিচার-বিশ্লেষণ' ছাড়াই ব্যক্তি বা ঘটনাকে নিখুত ও নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে পর্যবেক্ষণ করাই এর আসল উদ্দেশ্য। এটা এক ধরণের মানসিক ব্যায়াম।
মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস করা খুব সহজ। যে কেউই এটা করতে পারে। তবে পারফেকশন তখন ই আসবে যখন আপনি নিয়মিত ভাবে এটি দীর্ঘদিন অভ্যাস করবেন। শুরুতে, একটা শান্ত, নিরিবিলি জায়গা দেখে বসে পড়ুন। ঘড়িতে টাইমার সেট করে বসবেন। চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে ও ছাড়তে থাকুন। শ্বাস-প্রশ্বাসের উপরে আপনার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত। শ্বাসের আসা-যাওয়া নিবিড় ভাবে দেখতে থাকুন। এর মধ্যে যদি মনের ক্যানভাসে অন্য কোনো ভাবনা ফুটে ওঠে বা মন যদি অন্য কোথাও চলে যায়, একটুও বিরক্ত হবেন না। সচেতন ভাবে মনের যাবতীয় ফোকাস কে আবার যথা স্থানে অর্থাৎ নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর ফিরিয়ে আনুন। ব্যাস এইটুকুই। এটা এক ধরণের মাইন্ড ট্রেনিং। রোজ দশ মিনিটে র অভ্যাসই যথেষ্ট।
এছাড়া সমুদ্রের পাড়ে বা খোলা জায়গায় হাটতে হাটতেও মাইন্ডফুলনেস প্র্যাক্টিস করা যায়। চারপাশের প্রকৃতিকে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকুন। সমুদ্রের গর্জন, পাখির কোলাহল, পাতার শব্দ, পায়ের নীচের সবুজ ঘাস বা বালি - এক কথায় সকল বস্তুকে সূক্ষ ভাবে অনুভব করতে থাকুন।
কোনো গান বা মিউজিক শুনতে শুনতেও মাইন্ডফুলনেস প্র্যাক্টিস করা যায়। এক মনে শুনতে থাকুন। অন্য্ কোনো ভাবনা মনে আনবেন না বা কল্পনা করবেন না। চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকুন কিন্তু কোনো রকম বিচার বিশ্লেষণ করতে যাবেন না।
নিয়মিত রূপে মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিসে মনের অকারণ চঞ্চলতা কমে, শান্তি ও স্থিরতা লাভ হয়। স্ট্রেস লেভেল কম হয় , এঞ্জাইটি থেকে মুক্তি মেলে সহজেই। মনের একাগ্রতা অর্থাৎ ফোকাস করার ক্ষমতা বাড়ে। সর্বোপরি লাইফ কে আরও ভালো ভাবে হ্যন্ডেল করার যোগ্যতা লাভ হয়।
মাইন্ডফুলনেস ও মেডিটেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন 👇
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন