বছর শেষের এই কয়টা দিন সবাই পরিবার পরিজন , বন্ধুদের সাথে হই হুল্লোর করে কাটাতে চায়। বেশ একটা ছুটির আমেজ থাকে চারিদিকে। শীতের এই সময়টা মানেই পিঠে-পায়েষের সুগন্ধ , নরম তুলতুলে হাতে বোনা সোয়েটার এর নস্টালজিয়া , আবার রয়েছে হাল আমলের ক্রিসমাস পার্টি ও নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন, বন্ধুদের সাথে রাত ভর হুল্লোর, পিকনিক, পরিবার নিয়ে ট্রেনে চেপে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, আরও সব 'মন ভালো করা' কতো কিছু! ''মন ভালো করার পসরা" সাজিয়ে শীত আসে। 2022 আর 23 এর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এমনই হাজারো সুখস্মৃতি ও ভবিষ্যত-ভাবনা গুলি যখন প্রজাপতির মতো ডানা মেলতে শুরু করেছে , ঠিক তখন ই ভয় এবং দুর্ভাবনার সমস্ত স্মৃতিকে উসকে দিয়ে সামনে হাজির, Covid - BF.7 , করোনার এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট। চিনের বর্তমান পরিস্থিতি 2019 এর স্মৃতি কে উসকে দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় আছেন একে নিয়ে। এখানে আমরা জানার চেষ্টা করবো
BF.7 কি?
BF.7 কতটা ভয়ংকর?
ওমিক্রন BF.7 এর লক্ষণ গুলি কি কি? ( Symptoms )
FAQs
BF.7 কি?
বিগত তিন বছর যাবৎ যিনি গোটা বিশ্বে রীতিমত ত্রাস সৃস্টি করে গেছেন উনার নাম SARS-CoV-2 ( মূল ভাইরাস টির নাম )।
SARC-CoV-2 এর আক্রমণে শরীরে যে রোগলক্ষণ গুলি ( upper respiratory tract infection, mostly flu like symptoms ) প্রকাশ পায় তাকে Covid-19 বলা হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে , মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে টিকে থাকার জন্যে এই ভাইরাস টি বারবার তার রূপ বদল করে চলেছে। মিউটেশন এর মাধ্যমে এই রূপ বদল করে নতুন রূপ ধারণ করাকে ই variant বলে। আমাদের জানা এখন পর্যন্ত সর্বশেষ varient ওমিক্রন ( Omicron )।আমরা অভিজ্ঞতায় জানি , ওমিক্রন প্রজাতি ডেল্টা র ( Delta ) মতো এতটা ভয়ংকর নয়। মৃত্যুর হার কম। কিন্তু সংক্রমণ ছড়ায় খুব দ্রুত গতিতে। এইবার, এই ওমিক্রন বাবাজী তোমাকে বছর শেষে একটু চমক দিতে নিজের গেট আপ চেঞ্জ করে নতুন নামে হাজির ( genetic structure এ সামান্য বদল করে )। নাম তার BF.7 আদতে ইনি ওমিক্রনের ই পরিবর্তিত সংস্করণ অর্থাৎ sub-variant
BF.7 এর পুরো নাম BA.5.2.1.7
BF.7 কতোটা ভয়ংকর ?
এবার সবার মনেই এই প্রশ্ন টা ঘুরপাক খাচ্ছে , BF.7 কতোটা ভয়ংকর রূপে এবার হাজির হয়েছে। চীনে ইতিমধ্যেই ওমিক্রন BF.7 এর সংক্রমণ মারাত্বক আকার ধারণ করেছে। হাসপাতাল গুলিতে তিল ধারণের জায়গা নেই। রোগীমৃত্যুর ব্যপারে চীন কখনো সঠিক তথ্য দেয় না। বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী 3/4 মাসের মধ্যে দেশ টির মোট জনসংখ্যা র 65% লোকের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মৃত্যু হতে পারে 1.8 মিলিয়ন বা তার বেশী। মোটের উপর বলা চলে পরিস্থিতি সেখানে ভয়াবহ। ইতিমধ্যে ই সংক্রমণ ছড়িয়েছে চীন ছাড়াও দ: কোরিয়া, হংকং , ব্রাজিল , জার্মানি , ফ্রান্স , আমেরিকা ও ভারতে।
পরিস্থিতি কেন ভয়ংকর হতে পারে?
■ আমাদের এখানে এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট কতো টা বিদ্ধংসী হতে পারে সে বিষয়ে আমাদের ধারণা নেই।
■ RO - 10 to 18.6 অর্থাৎ এর সংক্রমণের হার অনেক বেশী , একটি ভাইরাস সর্বোচ্চ দশ থেকে আঠারো জন লোক কে সংক্রমিত করতে পারে।
■ এটি খুব দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
■ Incubation period কম হওয়ার ফলে RT-PCR টেস্টে ধরা না ও পড়তে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই আবার রোগীর কোনো শারীরিক উপসর্গ থাকে না। তখন রোগ শনাক্তকরণ ও আইসোলেশন কঠিন হয়ে পড়ে।
■ শীতকালীন সাধারণ সর্দি কাশির লক্ষণের সাথে মিল থাকায় রোগ শনাক্ত করতে অনিচ্ছাকৃত ভুল / দেরী হতে পারে।
■ করোনার আক্রমণের শুরুতে লক ডাউন ও অতিরিক্ত বিধিনিষেধ আরোপিত হওয়ায় আমাদের অনেকের ই নানা রকমের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাছাড়া ভারত বর্ষের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে কোরোনা তেমন বিদ্ধংসী প্রভাব ফেলে নি। ফলত আমরা এখন আর সরকারী বিধিনিষেধ কে তেমন তোয়াক্কা করি না। এই অতিরিক্ত আত্নবিশ্বাস ও বিদ্রোহী মনোভাবই বিপদ ডেকে আনতে পারে যে কোনো সময়।
■ এই উৎসবের মরশুমে অবাধ মেলামেশা ও স্বেচ্ছাচরিতা আমাদেরকে ভয়ানক বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
■ Cell Host and Microbe জার্নালে প্রকাশিত এক স্টাডি থেকে জানা যায় এই বিশেষ ভ্যারিয়েন্ট টি র neatralization resistance উহানে পাওয়া মূল ভাইরাস টি র চার গুণ। সুতরাং আমাদের দেহের ইমিউনিটি কে ফাঁকি দিতে বিশেষ ভাবে সক্ষম।
BF .7 এর মূল লক্ষণ( উপসর্গ ) গুলি কি কি?
● upper respiratory tract infection
● জ্বর
● সর্দি কাসি , নাক দিয়ে জল গড়ানো।
● গলা ব্যথা। ঢোক গিলতে অসুবিধা।
● বডি পেন। শারীরিক ক্লান্তি।
● কারোর কারোর ক্ষেত্রে পেট ব্যথা ,বমি এবং ডাইরিয়ার মতো লক্ষণ থাকতে পারে।
তাহলে বাঁচার উপায় কী?
যেহেতু ওমিক্রনের এই সাব-ভ্যারিয়েন্ট টি মানব দেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কে ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা রাখে , তাই আমাদের আরও বেশী সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। একমাত্র সঠিক তথ্য ও সচেতনতা ই এই ভাইরাসের সংক্রমণ কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
🔷️ প্যানিক করার মতো এখনো কিছু হয় নি। অকারণ উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা আমাদের কে মানসিক ভাবে দুর্বল করে এবং ইম্যুনিটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
🔷️ আদর্শ 'কোভিড বিধি' মেনে চলো। মাস্ক ব্যবহার , সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা , বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ইত্যাদি।
🔷️ অনাবশ্যক ভীড় এড়িয়ে চলা উচিৎ। খেয়াল রাখতে হবে যেন আমাদের থাকার বা কাজের জায়গায় পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ঢুকতে পারে।
🔷️ সুষম , স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলো। রোজকার খাবারে যেন যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালো কোয়ালিটি র প্রোটিন ( 75gm থেকে 100gm) থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতে হবে।
🔷️ প্রতিদিন অন্ততপক্ষে তিরিশ মিনিট সরাসরি sunlight এক্সপোজার জরুরী।
🔷️ Moringa ( সজ্নে ডাঁটা ), নিম , তুলসী , গুল মরিচ , হরিদ্রা , আদা , কালোজিরা র মতো দেশীয় উপাদান ই কোরোনা সহ যেকোনো ভাইরাল ইনফেকশন প্রতিরোধ ও নিরাময়ে বিশেষভাবে কার্যকর।
🔷️ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পর্যাপ্ত ও পরিমিত ঘুম জরুরী।
🔷️ নিয়মিত শরীরচর্চার কোনো বিকল্প নেই। এতে শুধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ই বাড়ে না, যেকোনো ইনফেকশন এর সাথে লড়াই করে জেতার চান্স ও বাড়ে। প্রতিদিন অন্ততপক্ষে 45 মিনিট মিডিয়াম বা হেভি ইনটেনজিটি এক্সেরসাইজ করা উচিৎ। জোড়ে হাঁটা , দৌড়ানো বা সাঁতার কাটা বা অন্য কোনো পছন্দের ব্যায়াম। ব্রীদিং এক্সেরসাইজ প্র্যাকটিস করো।
🔷️ যোগাসন ও প্রাণায়াম : যোগাসন চর্চা শুধু শরীর কে সুস্থই রাখে না , বাড়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এছাড়া ও এই আপতকালিন পরিস্থিতিতে আমাদের কে মানসিক ভাবে শান্ত ও রিলাক্স থাকতে সহায়তা করে। এখানে রইলো এমন ই সাত টি যোগাসনের তালিকা যেগুলি শুধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই বাড়ায় না , এই ভাইরাসের সাথে লড়াই করার শক্তি দেয়। চলো দেখে নেয়া যাক
করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে কোন কোন যোগাসন বিশেষভাবে সাহায্য করে -
1. পশ্চিমোত্তাসন
2. হস্তপদাসন
3. চক্রাসন
4. ত্রিকোণাসন
5. উস্ট্রাসন
6. ভূজঙ্গাসন
7. হস্তউত্তরাসন ( Raised arm pose)
এ ক্ষেত্রে ভ্রামরী ও ভ্রস্তিকা প্রাণায়াম নিয়মিত অভ্যাস বিশেষ ভাবে উপকারী।
FAQs
● Omicron BF.7 কি Delta ভ্যারিয়েন্ট থেকেও বেশী ক্ষতিকারক?
নি:সন্দেহে এটি বেশী সংক্রামক। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মৃত্যুর অনুপাত delta থেকে কম।
● আমাদের দেশে কবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রথম পাওয়া যায়?
এই বছরেই , অক্টোবরে ।
● টিকা নেয়ার পরেও কি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে?
হ্যা। টিকা নেয়ার ফলে বা আগে থেকে আক্রান্ত হয়ে থাকলে শরীরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে antibody তৈরী হয় তাকে ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা এই বিশেষ ভ্যারিয়েন্ট এর রয়েছে। টিকা নিলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুব একটা না কমলেও , আক্রান্ত হলেও সিভিয়ারিটি অনেক টা কম হতে পারে।
● বাচ্চাদের সংক্রমণের ঝুঁকি কতো টা?
এটা খুব ই highly infectious প্রজাতি। যে কেউ সহজে আক্রান্ত হতে পারে , এমন কি বাচ্চারা ও।
● এই ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় কি?
সচেতনতা ও সঠিক প্রতিরোধ ই এই ভাইরাস থেকে বাঁচাতে পারে।
পরিশেষে এটুকুই বলবো , ওমিক্রন BF.7 নিয়ে এখন ই প্যানিক করার মতো কিছু হয় নি। চীনের কথা আলাদা। ঘন জন বসতি , ভিন্ন জীবণযাত্রা , পরিবেশ এবং সর্বোপরি জন সংখ্যার অনুপাতে অপ্রতুল টিকাকরণ কর্মসূচি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে পরিবেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। টাটা ইনস্টিটিউট অফ জেনেটিক্স এন্ড সোসাইটি র ডিরেক্টর রাকেশ মিশ্রা পিটিআই কে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন , আমাদের দেশের পরিস্থিতি এখনো আয়ত্তের মধ্যেই রয়েছে, আমাদের অযথা ভয় পাওয়ার কোনো প্রয়োজণ নেই।
তথ্য সহায়তা :
WHO
UNICEF
ANANDA BAZAR
HINDUSTAN TIMES
বি:দ্র: এবছর দেশ জুড়ে কোভিড সংক্রমণ আবার হুহু করে বাড়ছে। আমরা জানি এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে নিজেদের ইম্যুনিটি কে শক্তিশালী করতে হবে। আযুষ মন্ত্রক, ভারত সরকার, আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন কিছু সাধারণ স্টেপস ফলো করার সুপারিশ করেছে। স্যানিটাইজার ও মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি এগুলি মেনে চলুন 🙏
Disclaimer : For information purpose only, should not be taken as substitute to standard medical advice.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন