প্রিয়জনের মৃত্যুশোক কিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারি?

 
প্রিয়জনের মৃত্যুশোক কিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারি? প্রিয় মানুষের আকস্মিক বা অকাল মৃত্যুতে নিজেকে সামলাব কি ভাবে?

প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদেরকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় ভীষণভাবে, আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। আর কোনো কারণে  সেই মৃত্যু যদি হয় আকস্মিক ও অপ্রত্যাশীত তাহলে সব কিছু যেন এক লহমায় এলোমেলো হয়ে যায়। চূড়ান্ত হতাশা ও মন খারাপের পালা চলতে থাকে। জীবনের ভীতটা ই যেন যায় নড়ে। স্বাভাবিকতায় ছন্দপতন ঘটে। জীবন থমকে যায় । একরাশ অভিমান গলার কাছ টায় দলা পাকিয়ে উঠতে থাকে, আর মাথায় গিজগিজ করে উত্তর না পাওয়া হাজারো প্রশ্ন। কখনো অনুতাপ ও অপরাধবোধ গ্রাস করে আমাদের। আমরা ভয় পেতে শুরু করি। মৃত্যু তখন আমাদের কাছে ভীষণ এক বিভীষিকা রূপে ধরা দেয়। আমরা ভুলেই যাই মৃত্যু হচ্ছে জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি যাকে কোনো অবস্থায়ই  এড়ানো যায় না।  জন্ম ও মৃত্যু নিয়েই জীবন। জন্ম ও মৃত্যু এই দুটি বিন্দু যে রেখায় যুক্ত রয়েছে সেটাই তো জীবণ ।।

কেনো আমরা প্রিয়জনের মৃত্যু মেনে নিতে পারি না?

প্রিয় মানুষের মৃত্যু যদি anticipatory হয়, অর্থাৎ আমরা আগে থেকেই জানতাম, উনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছেন, তাহলে আমরা ভেতরে ভেতরে সেইভাবে প্রস্তুত হতে পারি। যেমন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত কোনো প্রিয় মানুষ  বা কোমাতে আচ্ছন্ন কেউ যিনি বেশ কিছুটা সময় ধরে লাইফ সাপোর্টে আছেন, বা এমন কেউ যিনি  বার্ধক্য জনিত রোগে দীর্ঘ সময় কষ্ট পাচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে, বলতে কষ্ট হলেও , মৃত্যু কিছু টা কাঙ্খিত। কিন্তু কোনো প্রিয়জনের আকস্মিক ও অকাল মৃতুতে আমরা বেসামাল হয়ে পড়ি। কখনো নিজেকে দোষারোপ করি, তো কখনো পরিস্থিতিকে। কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। কেনো এমন হয়? একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, এমন হয় মূলত তিনটি কারণে, প্রথমত মৃত্যুর স্বাভাবিকতা ও প্রকৃত স্বরূপ উপলব্দি করার মতো আগ্রহ বা মানসিক স্থিরতা আমাদের নেই। দ্বিতীয়ত যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমরা বড়ো হয়েছি , সেখানে মৃত্যুকে খানিকটা অপাঙ্ক্তেয় করে রাখা হয়, মৃত্যু নিয়ে কেউ তেমন কথা বলে না। এই বিষয়ে সবাই কিছুটা আনকম্ফর্টেবল। জীবদ্দশায় সবাই মৃত্যুর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকতেই যেন স্বচ্ছন্দ বোধ করে। এছাড়াও নাটক, নভেল, গল্প , উপন্যাস , সিনেমাতে মৃত্যুর স্বাভাবিকতা কে অস্বীকার করে অযথা ভীতিপ্রদ ও অধিভৌতিক ঘটনা রূপে দেখানো হয়েছে বারবার। এইসব কারণে, আমাদের অজান্তেই অবচেতনে মৃত্যুকে এড়িয়ে চলা বা অস্বীকার করার প্রবণতা সঞ্চারিত  হয় ধীরে ধীরে আর এর থেকেই জন্ম নেয় এক ধরণের delution বা ভ্রান্তবিশ্বাস , হয়তো  " আমি বা আমার প্রিয়জনেরা কখনো মারা যাবো না।" ধীরে ধীরে এই delution   মন-মস্তিস্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং তখন  এই মিথ্যাটাকেই আমরা সত্যি বলে ধরে নেই নিজের অজান্তেই । বাস্তবে যখন  হঠাৎ কোনো কাছের মানুষ মারা যান, তখন এক লহমায় এই বিশ্বাস ভেঙ্গে চুর চুর হয়, এতদিনের সযত্নলালিত বিশ্বাসের ভীত নড়ে যায় বলেই আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি । আর তৃতীয় কারণটি হলো নির্ভরতা। যিনি চলে গেছেন উনার উপর আমাদের নির্ভরতা বা উনাকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশা। নির্ভরতা, হতে পারে তা  ব্যক্তিগত বা সামাজিক, আর্থিক, মানসিক, বৌদ্ধিক ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ে। প্রত্যাশার অ-প্রাপ্তি ও নির্ভরতার জায়গা টা আচমকা সরে  যায় বলেই আমরা মৃত্যুকে কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা। চলো মৃত্যুকে আরেকটু কাছ থেকে দেখি, বোঝার চেষ্টা করি এর প্রকৃত স্বরূপ আসলে কেমন ?  


প্রিয়জনের মৃত্যুতে নিজেকে সামলানোর উপায় কী?



মৃত্যুর প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটনে আধ্যাত্মিকতা : 


প্রাচীনকাল থেকেই পন্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটনে যথেষ্ট কৌতূহল লক্ষ্য করা যায়। গবেশনাও হয়েছে বিস্তর। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে , বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে  মৃত্যুর প্রকৃত স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমাদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ  বেদ , উপনিষদ ও পুরাণে এই বিষয়ে বিস্তারিত ব্যক্ষ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু এই গ্রন্থগুলিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেভাবে আলোচনা করা হয়েছে, তা বোঝার মতো যথেষ্ট আধ্যাত্মিক জ্ঞান আমাদের অনেকেরই নেই। একটু ম্যাচুওর কনটেন্ট। সঠিকভাবে অনুধাবন করতে প্রস্তুতি দরকার। তারচেয়ে গীতা অনেক সহজ ও বোধগম্য । গীতা লিখা হয়েছে সাধারণের জন্য। শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে সংলাপ, খানিকটা প্রশ্ন-উত্তর ধাঁচে লেখা হয়েছে । অর্জুন এখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কে রিপ্রেজেন্ট করছেন। একজন সাধারণ মানুষের মনে এই জগৎ - সংসার নিয়ে যতো ধারণের কৌতূহল/ প্রশ্ন থাকতে পারে তার সবগুলির ই উত্তর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে দিয়েছেন সহজ ও বোধগম্য ভাষায়। স্বাভাবিক ভাবেই এখানে জন্ম-মৃত্যুর প্রসঙ্গও এসেছে।


How to handle grief of death of a near and dear one

এখানে আত্মার অবিনশ্বরতার কথা বলা হয়েছে। আত্মার জন্ম বা মৃত্যু নেই। আত্মা শাশ্বত ও চিরন্তন। আত্মা গতিময়, চিরবহমান। এই গতিপথে সে বিভিন্ন জড়দেহ গ্রহণ ও ত্যাগ করে, কোনটায় আটকে থাকে না। আত্মার উপস্থিতিই 'জড়' কে সজীব করে তোলে। আত্মার দেহত্যাগের পর মৃত শরীর ' জড় ' পদার্থ ছাড়া আর কী ? আত্মার দেহান্তর হয় মাত্র , মৌলিক সত্ত্বার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। 

আমরা যেভাবে জীবণ কে এতকাল দেখে এসেছি , সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে  একটা বড়ো গলদ রয়ে গেছে, আর  সেটা হলো 'ব্যক্তি মানুষ'  কে আমরা তার ' দেহ ' ভেবে বসি। 'ব্যক্তিসত্ত্বা' এখানে 'দেহ' সর্বস্ব। দেহ নেই মানে মানুষ টা ও নেই! প্রায় সকল সভ্যতায় এবং প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে আত্মার অবিনশ্বরতা স্বীকার করা হয়েছে। তোমার দেহ আর তুমি কি এক? অবশ্যই না। তুমি শুধু প্রয়োজনে এই দেহ ধারণ করে আছো, সময় হলে ছেড়ে চলে যাবে। একটু সহজ করে বলি, 2 বছর বয়সে তোমার দেহ যে রকম ছিলো, আজ আর তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। সেই সময়কার তোমার কোটি কোটি দেহকোষের একটিও আজ বেঁচে নেই। সে জায়গাতে নতুন কোষ জন্মেছে। সূক্ষ্ম স্তরে এই জন্ম-মৃত্যুর খেলা চলছে অবিরত , যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না ।শৈশবের মৃত্যু হয় বলেই কৈশোর আসে, যৌবণের মৃত্যুতে আসে বার্ধক্য। দৃষ্টির অলক্ষে , এই ধারাবাহিক ভাবে ঘটে চলা রূপান্তরকে আমরা ধরতে পারি না। আমরা ভেবে নেই 2 বছর বয়সের আমার দেহ আর আজকের দেহ এক ই!! আর মন? সে তো প্রতি ক্ষণে পাল্টায়। আজকে যা কে পাগলের মতো ভালোবাসো কাল হয়তো তাকেই ঘৃণা করবে। মন নিত্য পরিবর্তনশীল। এতো কিছুর মধ্যেও যা অবিকৃত থাকে, সেই শাশ্বত সত্ত্বা ই তো তুমি! যে 'তুমি' এই দেহ-মন কে ধারণ করে আছো জাগতিক সব কিছু experience করার জন্য, সেই তুমি ই ' আত্মা ' যে নিত্য, যার কোনো বিনাশ নেই। আমরা জড় চোখ দিয়ে আত্মার জাগতিক যাত্রাপথ টুকু দেখতে পাই। দৈহিক মৃত্যুতে যার পরিসমাপ্তি ঘটে। এর পরেরটুকু আর দেখতে পাই না। যা কিছু দৃষ্টি র বাইরে রয়েছে তার অস্তিত্ব নেই এমন তো নয়। মৃত্যু নিয়ে তাই তো এতো হাহাকার! মৃত্যু আরেক টা নতুন পর্বের সূচনা করে মাত্র। আত্মার নিজস্ব সত্ত্বা ও তার গতিময়তা এক ই থাকে।

এতটুকু পড়ার পর যদি তোমার মনে কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে চলো এই তত্ত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যক্ষ্যা আছে কি না একটু বোঝার চেষ্টা করি। এমনিতেও বিশুদ্ধ আধ্যাত্মবাদের সাথে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই। এই বিশ্ব-ব্রম্হান্ডে যা কিছু আছে , যে সব ঘটনা নিরন্তর ঘটে চলেছে সব কিছুর মূলেই রয়েছে Pure energy.  এই energy বা শক্তির কোনো সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। সে চিরন্তন।  নিরন্তর বয়ে চলেছে। এক রূপ থেকে অন্যরূপে রূপান্তর ঘটে মাত্র। বিশ্ব ব্রম্হান্ডের সকল শক্তির উৎস তো এক ই। সেই এক ই মূল শক্তি  শুধু ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলে ভিন্ন রূপে ফ্লো করছে। সেই 'কসমিক এনার্জি'  নিজেকে বিভিন্ন রূপে manifest করছে ; কখনো সজীব , তো কখনো জড়। সবেতেই আছে। বিভিন্ন ভৌত বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত এই শরীরে এনার্জি একটা নির্দিষ্ট চ্যানেলে ফ্লো করছে বলেই  এই শরীর  জীবন্ত, আবার যখন এনার্জি ভিন্ন চ্যানেলে ভিন্ন ভাবে বইবে, তখন এই এক ই শরীর মৃত, জড় পদার্থ। জিবদেহের মৌলিক উপাদান গুলি ( carbon, nitrogen, hydrogen ও oxygen) এই পৃথিবীর পরিমণ্ডল থেকে নিয়েই আমাদের দেহ গঠিত হয়েছিলো একদিন , মৃত্যুর পর সেগুলি আবার  যথাস্থানে ফিরে যাবে। ( আমাদের শাস্ত্রে দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার কনসেপ্ট এর সমগোত্রীয় ধারণা ) আবার নতুন রূপে, নতুন কোনো ভৌতশরীরে এই 'কসমিকএনার্জি' ফ্লো করবে, তখন নতুন জীবণ তৈরী হবে। শুরু হবে প্রাণের স্পন্দন।composition ও decomposition এর খেলা চক্রাকারে অবিরাম চলতে থাকে।। 
সুতরাং, তুমি তোমার 'দেহ' নও, দেহ টা তোমার। তুমি তোমার মন ও নও, মন টা তোমার। তোমার মধ্যে যে ' তুমি ' টা রয়েছে, যে সব কিছু দেখছে, শুনছে, অনুভব করছে , এই দেহ-মনের মালিক যিনি , সেই ' তুমি ' ই  আত্মা বা Pure energy . যে তার যাত্রাপথে কিছুটা সময় জাগতিকতা বা 'বস্তু-জগৎ' কে experience করার জন্য এই দেহ ধারণ করেছো , সময় হলেই ফেলে চলে যাবে অন্য কোনো dimention এ। স্থূল শরীর ধারণ করার আগেও তুমি ছিলে, এই শরীর ত্যাগ করার পরেও তুমি থাকবে।।

 আত্মার প্রকৃত স্বরূপ অনুধাবন করলে , মৃত্যু নিয়ে এই অযথা ভীতি অনেকটা ই কেটে যাবে। 

প্রিয়জনের মৃত্যুর পরে শোক কাটাতে কী করণীয়?

মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি - এই বাস্তব সত্য টা কে এক্সেপ্ট কর। যিনি চলে গেছেন , উনার কথা প্রতি ক্ষণে মনে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। 

■ প্রথম থেকেই জোর করে মন কে ডাইভার্ট করো না, বরং 'শূন্যতা' কে ফেস করো। আবেগ সে যতই বেগবান হোক তাকে বইতে দাও। কান্না পেলে কাঁদো , রাগ , ক্ষোভ, অভিমান সব প্রকাশ করো। কোনো কিছু চেঁপে রেখো না।

■ Self counselling ও Meditation   শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।

■ শোকের এই আবহে , যা কিছু মনে আসছে ঘনিষ্ট কেউ থাকলে তার সাথে শেয়ার কর , নয়তো নিয়মিত ডাইরিতে লিখে ফেল।

■ দিনভর active থাকো। শারীরিক শ্রম বাড়াও। কায়িক শ্রম মন কে শান্ত করে।

■ যিনি চলে গেছেন , তাঁকে তোমার নিজের মতো করে শ্রদ্ধা জানাও। লোকাচার বা শাস্ত্রীয় বিধি মেনেই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।

■ তাঁর কোনো কাজ যদি অসমাপ্ত  থেকে থাকে, সেই কাজ সম্পূর্ণ করার সংকল্প করতে পারো। 

■ প্রয়োজনে break নাও, নিজের সাথে সময় কাটাও। জীবনের Priority গুলিকে ঝালিয়ে নিতে পারো।

■ বিদেহী র প্রতি কৃতজ্ঞতা ও প্রার্থনা শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য  করে।

🔷️ এইসব কিছুর  পরেও যদি কোনো কারণে এই শোক কাটিয়ে  উঠতে না পারো , নীচে দেয়া ফোন নাম্বারে ফোন করে কথা বলতে পারো। ফ্রি কাউনসেলিং এর ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজনে মনোচিকিৎসকের সাথে  online sesson ও বুক করতে পারো।


Dial - +8448844845 



Dial - +919137376327

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ডিপ্রেশন কে হালকা ভাবে নিয়ো না

চাকরি হারানোর ভয় কি আপনাকে রাত দিন তাড়া করে বেড়াচ্ছে?

2023 এ সুস্থ থাকতে ও অতিমারী থেকে বাঁচতে আজই শিখে নাও ডিপ ব্রীদিং