নিজের সাথে কথা বলা : জেনে নিন সেল্ফ এফার্মেশনের উপকারিতা

'সেল্ফ এফার্মেশন' বা 'পজিটিভ সেল্ফটক' মানে কী?

আমরা সারাক্ষণ ভেতরে ভেতরে  নিজের সাথে কথা বলে চলি। নিজের সাথে নিজের এই কথোপকথন কেই স্ব-কথোপকথন বা সেল্ফটক বলে। আমাদের ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাস, নৈতিকতা ও পরিবেশ এই স্ব-কথোপকথন কে প্রভাবিত করে। এই সেল্ফটক দু ধরণের হতে পারে - পজিটিভ ও নেগেটিভ। আজ আমাদের আলোচনার বিষয় পজিটিভ সেল্ফ টক বা ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন।


অধিকাংশ সময়ে যেহেতু এই স্ব-কথোপকথন গুলি সত:স্ফুর্ত ও অসচেতন অবস্থায় চলতে থাকে, তাই এর উপরে আমাদের খুব একটা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। প্রকৃতিগত ভাবে যেহেতু আমাদের মন সহজেই নেতিবাচক চিন্তা ভাবনায় প্রভাবিত হয়, তাই অসচেতন ভাবে চলতে থাকা অভ্যন্তরীণ এই আলাপচারীতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেগেটিভ হওয়াটা ই স্বাভাবিক। ফলে, কোনো কাজ করার আগে বা কোনো ঘটনা ঘটার আগেই  আমরা অহেতুক ভয় পেতে শুরু করি, আত্মবিশ্বাস কম হতে শুরু করে, মনে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পরে, দুশ্চিন্তা ও হতাশা ছড়িয়ে পরে  জীবনে। এটা প্রায় আমাদের সবার সমস্যা। এই অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার উপায় একটাই - মনের এই নেতিবাচকতা কে চ্যালেঞ্জ জানানো। স্বভাবে ভীরু এই মনকে বারেবারে আশ্বস্ত করা - তুমি পারবে। আর এটা করার একমাত্র রাস্তা হলো, সচেতন ভাবে  " পজিটিভ সেল্ফটক " বা " সেল্ফ এফার্মেশন " ( নিজেকে আশ্বস্ত করা ) প্র্যাকটিস  করা।


পজিটিভ সেল্ফটক বা সেল্ফ এফার্মেশন এর উপকারিতা :


নিজেকে আস্বস্ত করা  বা ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন আমাদের স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক সুস্থতার উপরে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। যখন আমরা ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন অনুশীলন করি, তখন আমরা নেতিবাচক চিন্তাভাবনা এবং আত্ম-সন্দেহে থাকার পরিবর্তে নিজেদের এবং আমাদের জীবনের ইতিবাচক দিকগুলিতে ফোকাস করার জন্য মূলত আমাদের অবচেতন মনকে পুনরায় প্রোগ্রাম করি। এখানে সেল্ফ এফার্মেশন বা ইতিবাচক স্ব-কথোপকথনের কিছু বিশেষ উপকারিতা উল্লেখ করা হলো -


মানসিক চাপ কমায় : 

ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন  মনকে শান্ত করে এবং একটি ইতিবাচক মানসিকতা প্রসার করে চাপের মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে। যখন আমরা সচেতন ভাবে ইতিবাচক চিন্তার উপর ফোকাস করি, তখন আমরা আরও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি এবং কম উদ্বিগ্ন বোধ করি।


আত্মসম্মান বৃদ্ধি করে : 

সেল্ফ এফার্মেশন আমাদের শক্তি এবং ইতিবাচক গুণাবলীর কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে। যখন আমরা নিজেদের সম্পর্কে ভাল বোধ করি, তখন আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। 


প্রেরণা জাগায় : 

পজিটিভ সেল্ফটক আমাদের ইতিবাচক মানসিকতা এবং উদ্দেশ্যের অনুভূতি প্রদান করে আমাদেরকে  লক্ষ্যে স্থির ও অনুপ্রাণিত থাকতে  সাহায্য করতে পারে। আমরা কী অর্জন করতে চাই সে সম্পর্কে যখন আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকে, তখন আমাদের এটি অর্জনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। 


সম্পর্কের উন্নতি ঘটায় : 

ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন আমাদেরকে আরও কার্যকর ভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে সাহায্য করে এবং নেতিবাচক স্ব-কথোপকথন হ্রাস করে যা আমাদের সম্পর্ক গুলিকে বিনষ্ট করতে পারে। মনের প্রসারতা বাড়ায় এবং সম্পর্ক গুলির প্রতি অধীক যত্নশীল থাকতে সাহায্য করে।


শারীরিক স্বাস্থ্য উন্নত করে :

ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন মানসিক চাপের মাত্রা হ্রাস করে এবং ভেতর থেকে রিলক্স ফীল করতে সাহায্য করে। মনে স্থিরতা ও প্রশান্তি এনে দেয়। ফলে আমাদের শরীর ও স্বাস্থ্য এর উপর যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা রক্তচাপ কমাতে, প্রদাহ কমাতে এবং ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। 


নিশ্চিতকরণ ( নিজেকে আশ্বস্ত করা ) বা ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন আমাদের স্বাস্থ্য এবং জীবনের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। নিয়মিত ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন অনুশীলন করে, আমরা আমাদের সামগ্রিক সুস্থতার উন্নতি ঘটাতে পারি এবং আরও সুখী, আরও পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারি।


Self affirmation


বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটা আজ প্রমাণিত যে  স্ব-কথোপকথন আমাদের শারীরিক ও মানসিক  স্বাস্থ্য উন্নত করতে কার্যকরী ভুমিকা নেয়।


পজিটিভ সেল্ফ-টক ও সেল্ফ এফার্মেশনের কার্যকারিতার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সমূহ : 



মানসিক চাপ হ্রাস: 

ব্যক্তিত্ব এবং সামাজিক মনোবিজ্ঞানের জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ইতিবাচক স্ব-কথন মানসিক চাপের মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে। এই গবেষণায়, যে  সমস্ত অংশগ্রহণকারীরা একটি চাপপূর্ণ কাজের সময় ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন অনুশীলন করেছিলেন তারা নেতিবাচক স্ব-কথোপকথনে নিযুক্তদের তুলনায় তাদের দেহে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের নিম্ন স্তর পরিলক্ষিত হয়েছে। 


মূড ভালো রাখে : 

জার্নাল অফ কগনিটিভ থেরাপি অ্যান্ড রিসার্চে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ইতিবাচক স্ব-কথন মেজাজ উন্নত করতে পারে এবং বিষণ্নতার লক্ষণগুলি হ্রাস করতে পারে। অংশগ্রহণকারীরা যারা ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন অনুশীলন করেছেন তারা নেতিবাচক চিন্তাভাবনা এবং হতাশার অনুভূতি উল্লেখযোগ্য  ভাবে কম ফীল করেছেন।


মনের স্থিরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক :

পজিটিভ সাইকোলজি নামক  জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ইতিবাচক স্ব-কথন স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে এবং স্ট্রেস  মোকাবিলায় দক্ষতা উন্নত করতে পারে। অংশগ্রহণকারীরা যারা ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন অনুশীলন করেছিল তারা চাপের পরিস্থিতিগুলি পরিচালনা করতে এবং বিপত্তি থেকে আরও দ্রুত বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। 


উন্নত শারীরিক স্বাস্থ্য : 

জার্নাল অফ বিহেভিওরাল মেডিসিনে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ইতিবাচক স্ব-কথন শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যে সমস্ত অংশগ্রহণকারীরা ইতিবাচক স্ব-কথোপকথনে নিযুক্ত ছিলেন তারা স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের নিম্ন স্তর দেখিয়েছেন এবং যারা নেতিবাচক স্ব-কথোপকথনে নিযুক্ত ছিলেন তাদের তুলনায় তাদের রক্তচাপ কম ছিল। 


উন্নত অ্যাথলেটিক পারফরম্যান্স:

জার্নাল অফ স্পোর্ট অ্যান্ড এক্সারসাইজ সাইকোলজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ইতিবাচক স্ব-কথন অ্যাথলেটিকদের দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা উন্নত করতে পারে। সাইক্লিং ব্যায়ামের সময় যারা ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন ব্যবহার করেন তারা যারা ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন ব্যবহার করেননি তাদের তুলনায় উন্নত কর্মক্ষমতা ও সক্ষমতা  দেখিয়েছেন। 


ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন এর কিছু উদাহরণ :


● শারীরিক ও মানসিক ভাবে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ ও নিরোগ।

● যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে আমি একশ শতাংশ ডেডিকেটেড ও মোটিভেটেড  থাকি।

● আমি আত্মবিশ্বাসী নিজের যোগ্যতায়। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমি স্থির ও শান্ত থাকতে পারি। 

● কাজকে কখনো আমি ভয় পাই না। কোনো কাজ সে যতো কঠিন ই হোক, একবার যদি মনস্থির করি , তবে সেই কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত থামি না।

● আমি সবার জন্য মঙ্গল কামনা করি, সবাইকে ভালোবাসি। সবাই আমাকে ভালোবাসে।

● বাইরে সব সময় প্রকাশ না করলেও আমি ভেতরে নিরন্তর সুখ ও আনন্দ অনুভব করি।

● এই অমূল্য জীবনের জন্য আমি সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের / উপরওয়ালার প্রতি আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি বিশ্বাস করি, সব সময় উনার কৃপাদৃষ্টি আমার উপর বর্ষিত হচ্ছে।

● আমি কাউকে ভয় পাই না ।


উপসংহারে, এখন আমাদের হাতে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ রয়েছে যাতে এই কথা সহজেই প্রমাণিত হয় যে স্ব-কথোপকথন ও পজিটিভ এফার্মেশন সামগ্রিক ভাবে আমাদের জীবনের মান উন্নত করতে ইতিবাচক ভুমিকা নেয়। সুতরাং  আপনার দৈনন্দিন রুটিনে ইতিবাচক স্ব-কথোপকথন অন্তর্ভুক্ত করলে  চাপের মাত্রা কমাতে, মেজাজ উন্নত করতে, স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে,  শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থের উন্নতিতে এবং বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে উদ্দম ও কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। 


এই প্রসঙ্গে আমার ভীষণ প্রিয় একটি ভিডিও এখানে শেয়ার করছি।

#sandeepmaheswari 🙏🙏






মন্তব্যসমূহ

  1. দারুণ লিখেছেন। আমাদের সবারই নিজের সাথে কথা বলা খুব দরকার।🌹🌹🌹🌹

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ডিপ্রেশন কে হালকা ভাবে নিয়ো না

চাকরি হারানোর ভয় কি আপনাকে রাত দিন তাড়া করে বেড়াচ্ছে?

2023 এ সুস্থ থাকতে ও অতিমারী থেকে বাঁচতে আজই শিখে নাও ডিপ ব্রীদিং