কেন আমরা রেগে যাই? জেনে নাও রাগ এর আসল কারণ
ক্রোধ বা রাগ কে অনেকেই নেগেটিভ ইমোশন বলে মনে করেন। কেননা অনেক সময় অতিরিক্ত রাগ শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। রাগের বশে কেউ কেউ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ ঘটিয়ে ফেলেন। তাই আমরা রাগ কেই ভিলেন ভাবি। ব্যক্তি বিশেষে রাগের ধরণ ও তা প্রকাশের মাত্রাও ভিন্ন হয়। রাগ কে অনেকেই "নেগেটিভ ইমোশন" মনে করেন। এখন তোমরা হয়তো ভাবছো, ' রেগে যাওয়া ' টা নিশ্চই তাহলে কোনো মানসিক ব্যাধি বা সমস্যা। না। একদম ই তা নয়। হাসি, কান্নার মতো ' রেগে যাওয়া ' টা ও একটা সহজ, স্বাভাবিক মানসিক প্রবৃত্তি। সবার ই রাগ হয়। রাগ ভীষণ শক্তিশালী একটা ইমোশন। এর শক্তি অসীম । এই শক্তিকে তুমি কী ভাবে ব্যবহার করছো , তার উপরই নির্ভর করছে এর প্রভাব পজিটিভ হবে নাকি নেগেটিভ। চলো একটু ডিটেলে বোঝার চেষ্টা করি।
রাগ কি? কেন আমরা রেগে যাই?
আগেই বলেছিলাম রাগ একটা শক্তিশালী এনার্জি। সাধারণত কোনো আঘাত বা ক্ষতির সম্মুখীন হলে /আশঙ্কা থাকলে , নিজের অহং বোধে চোট লাগলে , প্রত্যাশার অপ্রাপ্তিতে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে মনের গভীরে জন্ম নেয় রাগ , এর প্রকাশ সাধারণত বহির্মুখী এবং এর প্রভাব শরীর, মন ও সম্পর্কের ( সামাজিক ) উপর পড়ে। রাগ হওয়া বা রেগে যাওয়া টা দোষের নয় , এটা একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানসিক প্রতিক্রিয়া কিন্তু যখন রাগ কে আমরা সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারি না , তখন ই এর খারাপ প্রভাব গুলি আমাদের জীবনে পরিলক্ষিত হয়। রাগের বশবর্তী হয়ে আমরা অনেক সময়ই ভুল করি, পরে অনুতপ্ত হই । কখনো আবার মারাত্বক অপরাধও করে ফেলি , যা সময় বিশেষে ক্ষমার অযোগ্য।
কেনো আমরা অনেক সময় অল্পেতেই রেগে যাই ? অল্পেতে রেগে যাওয়ার কারণ :
ব্যক্তি বিশেষে রাগের কারণ গুলিও ভিন্ন হয় , কে কী কারণে রাগ করবে সেটা অনেকটা ই তার মানসিক গঠণে র উপর নির্ভর করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাহ্যিক পরিবেশগত কিছু কারণ ' রাগ ' এর অনুভূতি কে ট্রিগার করে। তাছাড়াও রয়েছে কিছু গুরুত্বপুর্ণ factors যেগুলি শারীরিক ও মানসিক দুই ধরণেরই হতে পারে । যেমন - অহংবোধ ( স্ট্রং ইগো ), দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক, শারীরিক যন্ত্রণা ( ফিজিক্যাল পেইন ), হরমোনাল ইমব্যালেন্স , নেশায় আসক্তি , দুশ্চিন্তা , ক্রনিক স্ট্রেস বা অন্য কোনো মানসিক কষ্ট , দীর্ঘ দিনের চাপা ক্ষোভ , বিরক্তি বা ভয়।
উপরে উল্লেখিত factor গুলি যদিও সরাসরি রাগের উৎপত্তি ঘটায় না, তবে এরা রাগ উৎপত্তির অনুকূল পরিবেশ ( Chronic irritability ) তৈরী করে। এগুলি মনকে ধীরে ধীরে সংকীর্ণ , দুর্বল , ভীত ও অসহিষ্ণু করে তোলে , তখন সামান্যতম exertarnal stimulant ( নির্দিষ্ট ব্যক্তি, ঘটনা বা পরিবেশগত কোনো কারণ ) পেলেই আমরা রেগে যাই।
রাগ প্রকাশের ধরণ বা রাগ কে আমরা ঠিকঠাক handle করতে পারছি কি না তার উপর নির্ভর করছে রাগ আমাদের জীবনে কি ধরণের প্রভাব ( পজিটিভ না নেগেটিভ ) ফেলবে। অনেকেই রাগকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন ( How to control anger? ) । নিয়ন্ত্রণ মানে কিন্তু রাগ কে চেপে রাখা বা অস্বীকার করা নয় , বরং রাগ এর প্রকৃত কারণ বিশ্লেষণ করে সেই অনুযায়ী স্টেপ নেয়া ( এই এনার্জি কে সঠিক দিশায় চ্যানেলাইজ করতে পারাটা ই আসল কথা। আবার কখনো বাইরে কিছু করার দরকার পড়ে না, শুধু নিজেকে ম্যানেজ করতে হয় )। মানসিক স্থিরতা ও বুদ্ধিমত্তা রাগ ( এর এনার্জি ) কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করে। রাগ কে তুমি যেভাবে প্রকাশ করছো তার উপরেই নির্ভর করছে এটি তোমার জীবনে উপকারী না ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে আসবে। অনিয়ন্ত্রিত রাগের প্রকাশ বিদ্ধংসী ঝড়ের মতো , সবসময়েই ধ্বংসাত্মক , কিন্তু আবেগের এই ঝড় কেই যদি সঠিক পথে পরিচালন করা যায়, তাহলে তা জীবন বদলে দিতে পারে ( অবশ্যই ভালো অর্থে 😀 )
ব্যক্তি বিশেষে রাগ প্রকাশের ধরণ ও ভিন্ন হয়। একে আমরা মূলত 2 ভাগে ভাগ করতে পারি। আকস্মিক ও অনিয়ন্ত্রিত এবং নিয়ন্ত্রিত।
আকস্মিক ও অনিয়ন্ত্রিত : এই ক্ষেত্রে রাগের প্রকাশ তাৎক্ষনিক ও অনিয়ন্ত্রিত। ঘটনার আকস্মিকতায় সাময়িক ভাবে আমদের বিচার বিবেচনা লোপ পায়। দেহ-মনে এক প্রকার ঝড় বয়ে যায়। এর তীব্রতা এতটা ই যে আমরা কাকে কী বলছি বা করছি তার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরণের আবেগ নিজের ক্ষতিই করে।
নিয়ন্ত্রিত রাগ প্রকাশ কে আবার 2 ভাগে ভাগ করা যায় --
● স্বেচ্ছায় রাগ কে চেপে রাখা বা সপুর্ণ অস্বীকার করা। যারা ' রাগ করা ' কে চরিত্রের দুর্বলতা ভাবেন তারাই এভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এতে কিন্তু হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী । দীর্ঘ সময়ের অবদমিত রাগ শরীর ও মনের যথেষ্ট ক্ষতি করে।
● সুপরিকল্পিত ভাবে রাগ প্রকাশ করা । সঠিক কারণ বিশ্লেষণ করে রাগ কে সঠিক পথে যারা পরিচালনা করতে পারেন , তাঁরা ই জীবনে জয়ী হন। যেখানে কোনো স্টেপ নিতে হবে (action) সেখানে স্টেপ নেয়া , প্রয়োজনে সরাসরি সংঘাতেও পিছুপা না হওয়া , তর্ক করা , আবার অবস্থা অনুযায়ী সমস্যা সমাধানে বিকল্প পথ খুঁজে বার করা , প্রয়োজনে এই শক্তিকে বৃহত্তর কোনো উদ্দেশ্যে বা সৃজনশীল কাজে ব্যবহার করা বা ক্ষেত্র বিশেষে অন্যকে এক্সেপট করা , বা ক্ষমা করা। এই শক্তিকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী চ্যানেলাইজ করার জন্য যথেষ্ট ম্যাচুয়রিটি ( মানসিক স্থিরতা ও বুদ্ধিমত্তা ) প্রয়োজণ।
এই প্রসঙ্গে দুটো গল্প বলি , বিহারের গয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে দশরথ নামে একজন গরীব, শ্রমিক ছিলো। সে পাথর ভাঙ্গার কাজ করতো। ঐ গ্রামের বেশীরভাগ মানুষ পাথরের খাদানে পাথর ভাঙ্গার কাজ ই করতো। পাথুরে পাহাড়ি অঞ্চল , চাষ বাসের তেমন সুযোগ ছিলো না। একদিন দুপুরে দশরথের স্ত্রী খাবার নিয়ে যাবার সময় পাহাড়ের উপর থেকে পা পিছলে নীচে পড়ে যায়। প্রচন্ড আঘাতে রক্ত ক্ষরণ শুরু হয় এবং অচৈতন্য হয়ে পড়ে। গ্রাম্য চিকিৎসক শত চেষ্টা করেও ওকে বাঁচাতে পারে নি। দশরথ শোকে পাথর হয়ে যায় । অন্যেরা বলাবলি করে, শহরের বড়ো হাসপাতালে নিয়ে গেলে বৌটা কে বাঁচানো যেত । কিন্তু নেবে কী করে ? রাস্তাই তো নেই। গ্রাম আর শহরের মাঝে দাড়িয়ে আছে এই প্রকান্ড পাহাড়। ঘুর পথে গেলে দুরত্ব অনেক বেশী, সুতরাং এই গ্রামের মানুষের কাছে শহরে গিয়ে চিকিৎসা করানো অসম্ভব ব্যপার। ভীষণ রাগে দুঃখে দশরথ চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ওর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো ওই পাহাড় টা র উপর। ওই রাক্ষুসে পাহাড় টা কে সরাতেই হবে। সকালে সবাই দেখ্লো একটা সামান্য ছেনি আর হাতুড়ি নিয়ে দশরথ যাচ্ছে পাহাড় কাটতে! সবাই ভাবলো বৌ এর শোকে লোক টা পাগল হয়ে গেছে। দিনভর দশরথ হাতুড়ি চালাত, রাতে বিশ্রাম। পরের দিন আবার শুরু। একটা ই লক্ষ্য , যে পাহাড় ওর বৌ কে মেরেছে সেই পাহাড়কে ও কেটে সরাবে। সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় একদিন পাহাড়ের বুক চিড়ে ও রাস্তা বানিয়ে ফেললো। এখন থেকে এই গ্রামে আর কেউ কোনোদিন বিনা চিকিৎসায় মরবে না। শহরে এখন খুব তাড়তাড়ি পৌছানো যায়। এই বিশাল পরিমাণ পাথর কেটে সরাতে ওর 22 বছর সময় লেগেছিলো। রাগের মধ্যে কতো বিশাল শক্তি লুকানো থাকে তা সহজেই অনুমান করতে পারছো । দশরথ মাঝি - The mountain man.
দ্বিতীয় গল্প। পরাধীন ভারত । ব্যবসায়ী পরিবারে বেড়ে ওঠা এক পার্সী যুবক। চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলা। ভারতীয় দের পক্ষে ব্যবসা করা টা তখন সহজ ছিলো না। এর মধ্যেই নিজের ইচ্ছা শক্তি , একাগ্রতা ও মেধার জোড়ে তৎকালিন বণিক মহলে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা করে নিচ্ছিলেন। ব্যবসার পাশাপাশি সুযোগ পেলেই দেশের জন্য কিছু করতেন সাধ্য মতো। এর মধ্যেই একদিন কোনো এক প্রয়োজনে উনাকে ' ওয়াটসনস ' হোটেলে যেতে হয়েছিলো। এটি ছিলো পরাধীন ভরতের সবচেয়ে বিলাশ বহুল হোটেল। ইয়ুরোপিয়ো মালিকানাধীন এই হোটেলে ভারতীয় দের প্রবেশ ছিলো নিষিদ্ধ। নিজের পরিচয় দেয়ার পরেও ওই যুবক কে সেদিন হোটেল কর্তৃপক্ষ প্রবেশের অনুমতি দেয় নি, শুধু সে ভারতীয় বলে। ভীষণ অপমানিত বোধ করেন। স্বভাবতই তাঁর যথেষ্ট রাগ ছিলো ওই হোটেল গোষ্ঠী ও তাদের ' ওয়ার্ক এথিকস ' নিয়ে।এতো বৈষম্য !! সেদিন ই সিদ্ধান্ত নেন তৈরী করবেন এমন এক হোটেল যা বৈভবে ' ওয়াটসনস ' থেকেও বড়ো হবে, যেখানে থাকবে না কোনো বৈষম্য। যেকোনো দেশের নাগরিকেরা পাবে প্রবেশাধিকার। 1903 সালে জন্ম নিল তৎকালিন বম্বেতে " তাজ হোটেল "।। অচিরেই টাটা গোষ্ঠীর এই হোটেলের সুনাম দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়লো। আলাদা করে আর ওই পার্সী যুবকের পরিচয় দিলাম না।
Taj Hotel - a sweet revenge
রাগ কমানোর উপায় ( রাগ নিয়ন্ত্রণের 5 টি কার্যকরী টিপস ) How to control anger/ 5 tips to control anger :
■ খুব বেশী রেগে গেলে, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেকে ওই পরিবেশ থেকে সরিয়ে আনো । ব্রেক নাও। কিছুক্ষণ হেটে আসতে পারো।
■ ঠান্ডা জল খাও। অনেকে আবার কিছুটা সময় বরফ মুঠো করে ধরে থাকতে বলেন। মিষ্টি কিছু খেতে পারো যেমন তোমার ফেবারিট চকোলেট বা আইসক্রিম !! ট্রাই করে দেখতে পারো।
■ কিছুটা সময়ের জন্য অন্য কিছুতে ফোকাস কর।
ফোকাসড ব্রীদিং ও রিলাক্সিং টেকনিক শিখতে পারো। এগুলি তাৎক্ষণিক ভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
■ রাগের মাথায় কিছু বলা বা করা থেকে বিরত থাকো। নিজের সাথে কিছুটা সময় কাটাও। যা কিছু মনে আসছে লিখে ফেলো। প্রয়োজনে মনের ভাবনা গুলি কাছের মানুষের সাথে শেয়ার কর।
■ ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা প্র্যাকটিস কর। স্বাবলম্বী হও এবং প্রত্যাশা কমাও। একটা কথা মনে রাখবে, এই পৃথিবীতে কেউ তোমার প্রত্যাশা পুরণ করতে আসে নি। প্রত্যেকের নিজস্ব সত্ত্বা ও স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই জীবনে এগুতে হয়।
রাগ তো করে ফেলি। কিন্তু রাগ করার পেছেনের কারন গুলো অসাধারণ লেখনীর মাধ্যমে আমাদের সামনে সবিস্তারে তুলে ধরার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ 👌🌹👌🌹👌
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ ❤
উত্তরমুছুন